
নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এইচআরডব্লিউ।
সোমবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে এই তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া গত বছরের ওই আন্দোলনের সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারা বেশি নির্ধারণ করে দিতেন বলেও রিপোর্টে উঠে এসেছে।
এমনকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হওয়া শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে অন্তর্বর্তী সরকার লড়াই করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ইলেইন পিয়ারসন বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রায় একহাজার বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এটি বাংলাদেশে অধিকার-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করেছে। কঠিন এই লড়াইয়ে জয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সব অগ্রগতি হারিয়ে যেতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করে। কাঠামোগত এমন সংস্কার করতে হবে যা ভবিষ্যত সরকারের যে কোনো দমন-পীড়নকে প্রতিরোধ করতে পারে।”
‘আফটার দ্য মনসুন রেভোলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে যে অতীতে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনী সবসময় রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন, জুলাই-আগস্টের গণবিদ্রোহের সময় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকেই এসেছে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, অস্থিরতার সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠপর্যায়ের অফিসারদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারাই বেশি নির্ধারণ করে দিতেন।’
অন্য একজন অফিসার বলেছেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদেরকে কঠোর হতে এবং নৈরাজ্য ছড়ানো কোনও অপরাধীকে রেহাই না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা স্পষ্টভাবে ‘গুলি করো’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলী স্পষ্ট ছিল, সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, আপনি যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিন।’
এদিকে বলপূর্বক গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা বা তার সরকারের সিনিয়র সদস্যরা এই ধরনের অসংলগ্ন আটকের বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে হাসিনা সরাসরি বলপূর্বক গুম বা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’
নিরাপত্তা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, ‘আবদুল্লাহিল আমান আজমির আটক এবং গোপন আটককেন্দ্রে থাকা অবস্থায় তার স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার বিষয়ে হাসিনা সরাসরি অবগত ছিলেন।’
তিনি বলেন, আজমি সাবেক সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তার সহকর্মী হওয়ায় তিনি শেখ হাসিনার কাছে তাকে মুক্তি দেয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবার তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হাসিনা।’
তিনি এইচআরডব্লিউর কাছে দাবি করেছেন, হাসিনা এমনকি আজমিকে হত্যা করার পরামর্শও দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি তা করিনি। কিন্তু আমি তার মুক্তির বিষয়ে আবেদন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে। এইচআরডব্লিউ জুলাই এবং আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দায়ের করা আটটি ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) পর্যালোচনা করেছে, যার মধ্যে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসহ ২৯৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাত ব্যক্তি রয়েছেন ৬০০ জন।
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, মনসুন বা বর্ষা বিপ্লবের সময় হাসিনা সরকারকে নিজেদের রিপোর্টিংয়ে মাধ্যমে সমর্থন করার জন্য পুলিশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত, কর্তৃপক্ষ বর্ষা বিপ্লবের বিষয়ে প্রতিবেদন করার জন্য কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে।
এইচআরডব্লিউ’র এই প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আইন প্রয়োগের তত্ত্বাবধানে থাকা কর্মীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এ ছাড়া প্রসিকিউশন এবং বিচার বিভাগ যাতে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্যও সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থা।’