নিজস্ব প্রতিবেদক: দিনক্ষণ ঠিক না হলেও আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দলের নিবন্ধন ও দলীয় মার্কা ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পাওয়ারও আশা করছে। নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করাসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে দলটি। জানা গেছে, প্রতিদিনই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতারা।
গত কয়েকদিনে ময়মনসিংহ, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জসহ কয়েক জেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক আসনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে দলটি। এতে স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াত ও ছাত্র সংগঠন শিবির নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা প্রার্থীদের ছবি দিয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন। করছেন সমাবেশ।
কয়েক জেলায় প্রার্থী ঘোষণা জামায়াতের: আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে টাঙ্গাইলে ৮টি, নেত্রকোনার ৫টি, ময়মনসিংহের ১১টির মধ্যে ১০টি, শরীয়তপুরে ৩টি, ফরিদপুরের ৪টি, গোপালগঞ্জের একটি সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত। গত শুক্রবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ময়মনসিংহ জেলার জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর নামের তালিকা ছড়িয়ে পড়ে। পরে ময়মনসিংহ জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মোজাম্মেল হক আকন্দ তালিকার সত্যতা কালবেলাকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, স্থানীয় মতামত ও মাঠপর্যায়ের জরিপের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় জামায়াতে ইসলামী সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১০টি আসনে চূড়ান্ত হলেও একটি আসনে এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি। তিনি আরও বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ জামায়াতের নেতৃত্ব দেখতে চাচ্ছে, যা আমাদের উৎসাহিত করছে। প্রার্থীরা প্রতিটি গ্রামের ওয়ার্ড পর্যায়ে গণসংযোগ করবেন, সঙ্গে দলীয় লোকজনও কাজ করবেন। গ্রামের মানুষ যে ধরনের সমস্যায় জর্জরিত, সেই সমস্যাগুলো শুনতে পারবেন। মাঠে যত বেশি দৌড়াবে, মানুষের আগ্রহ তত বাড়বে। ফলে মানুষ খুব কাছে চলে আসবে। মানুষের স্বপ্ন জামায়াতে ইসলামী বাস্তবায়ন করতে পারবে। আবার যদি জোট হয়, তাহলে জাতীয় ঐক্যের জন্য যে কোনো আসন আমরা ছেড়ে দেব। জাতীয় স্বার্থে যে কোনো ত্যাগ করতে জামায়াতে ইসলামী প্রস্তুত থাকবে।
ময়মনসিংহে জামায়াতের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীরা হলেন ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনে জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মাহফুজুর রহমান, ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনে সাবেক উপজেলা আমির মাহবুব মণ্ডল, ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে উপজেলা শাখার আমির মাওলানা বদরুজ্জামান, ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনে মহানগর জামায়াতের আমির কামরুল আহসান, ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি ও ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির কামরুল হাসান, ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনে মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির আসাদুজ্জামান, ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে উপজেলা জামায়াতের আমির মঞ্জুরুল হক, ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনে ইসমাইল হোসেন ও ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনে উপজেলা শাখার আমির সাইফ উল্লাহ পাঠান। ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনে প্রার্থী এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
টাঙ্গাইলে ৮টি আসনে প্রাথমিকভাবে মনোনীত প্রার্থীরা হলেন টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) অধ্যক্ষ মন্তাজ আলী, টাঙ্গাইল-২ (ভুঞাপুর-গোপালপুর) হুমায়ূন কবীর, টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) হুসনে মোবরক বাবুল, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) অধ্যাপক খন্দকার আব্দুর রাজ্জাক, টাঙ্গাইল-৫ (টাঙ্গাইল সদর) আহসান হাবীব মাসুদ, টাঙ্গাইল-৬ (বাসাইল-সখীপুর) শফিকুল ইসলাম খান, টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ তালুকদার, টাঙ্গাইল-৮ (দেলদুয়ার-নাগরপুর) ডাক্তার আব্দুল হামিদ। নেত্রকোনার ৫টি আসনে মনোনীত প্রার্থীরা হলেন নেত্রকোনা-১ (দুর্গাপুর-কলমাকান্দা) আসনে কলমাকান্দা উপজেলা আমির অধ্যাপক আবুল হাশেম, নেত্রকোনা-২ (সদর-বারহাট্টা) আসনে সাবেক জেলা আমির ও ময়মনসিংহ অঞ্চল টিম সদস্য অধ্যাপক এনামুল হক, নেত্রকোনা-৩ (আটপাড়া-কেন্দুয়া) আসনে আটপাড়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান দেলাওয়ার হোসেন সাইফুল, নেত্রকোনা-৪ (মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী) আসনে ময়মনসিংহ মহানগরী জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আল হেলাল তালুকদার, নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনে জেলা জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও পূর্বধলা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুম মোস্তফা।
গত শুক্রবার শরীয়তপুর জেলার ৩টি আসনের চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য এবং শরীয়তপুর জেলা শাখার নায়েবে আমির কে এম মাকবুল হোসাইন। তিনি জানান, ফরিদপুর অঞ্চলের সব উপজেলা এবং পৌরসভার নেতাদের সম্মেলনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও ফরিদপুর অঞ্চলের পরিচালক, সাবেক এমপি এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ আনুষ্ঠানিকভাবে শরীয়তপুরের ৩টি আসনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। প্রার্থীরা হলেন শরীয়তপুর-১ (পালং-জাজিরা) আসনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি ড. মোশাররফ হোসেন মাসুদ তালুকদার, শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া ও সখিপুর) আসনে ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন বকাউল এবং শরীয়তপুর-৩ (ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট) আসনে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম।
এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৫টিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তারা হলেন কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনে জামায়াতের জেলা কমিটির সদস্য মোসাদ্দেক আলী ভূঁইয়া, কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে কটিয়াদী উপজেলা কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনে ছাত্রশিবিরের সাবেক ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ রোকন রেজা, কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনে জেলা জামায়াতের আমির রমজান আলী এবং কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর) আসনে ভৈরব উপজেলা জামায়াতের আমির কবির হোসেন। তবে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে প্রার্থীর নাম এখনো ঘোষণা করা হয়নি। এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমির রমজান আলী বলেছেন, শনিবার কিশোরগঞ্জ সদরের উবাই পার্কে কিশোরগঞ্জ জেলা ও উপজেলার জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্যদের নিয়ে বার্ষিক পরিকল্পনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল হক ফারুকী কিশোরগঞ্জের সংসদীয় পাঁচটি আসনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন।
ওদিকে বেশ কিছু দিন আগেই ঠাকুরগাঁওয়ের ৩টি নির্বাচনী আসনে জামায়াতের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। ওই তিন আসনে প্রার্থীরা হলেন-ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য দেলাওয়ার হোসেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনে (বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর-রানীশংকৈলের একাংশ) জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আব্দুল হাকিম এবং ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে (পীরগঞ্জ- রানীশংকৈলের একাংশ) জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক বেলাল উদ্দীন প্রধান। ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনের প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেন (সাঈদী) বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী দল। এরই মধ্যে অনেক সংসদীয় আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে আমাকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আমি ছাত্রজীবন থেকেই এলাকায় নানামুখী সামাজিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ঠাকুরগাঁওয়ের উন্নয়নে নানামুখী কাজের উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, মানুষ এখন সামগ্রিকভাবে তরুণ নেতৃত্বের দিকে ঝুঁকছে। কারণ বিশ্বব্যাপী তরুণরাই এখন পরিবর্তনের কার্যকর শক্তি। তাই স্থানীয়ভাবে তরুণ-যুবকদের ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছি। এ ছাড়া ফরিদপুরের ৪টি সংসদীয় আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। জেলা জামায়াতের আমির মো. বদরউদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারে দলের কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত শনিবার কেন্দ্র থেকে ফরিদপুরের সবকটি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে।
ফরিদপুরের ৯টি উপজেলা নিয়ে ৪টি সংসদীয় আসন গঠিত। এর মধ্যে আলফাডাঙ্গা-বোয়ালমারী-মধুখালী এই তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসন। এই আসনে ঢাকা জেলা শাখার শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য ইলিয়াছ মোল্লাকে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। তার বাড়ি মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া ইউনিয়নের কালপোহা গ্রামে। ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-সালথা) আসনে নগরকান্দা উপজেলা জামায়াতের আমির সোহরাব হোসেনকে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি নগরকান্দার তালমা নাজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এর আগে তিনি নগরকান্দা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলেন। ফরিদপুর-৩ (সদর উপজেলা) আসনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও ফরিদপুর অঞ্চলের টিম সদস্য আবদুত তাওয়াবকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বোয়ালমারী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও ফরিদপুর শহরের লক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা। আবদুত তাওয়াব ২০১৪ সালে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে ভাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের আমির সরোয়ার হোসেনকে জামায়াতের প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। তার বাড়ি ভাঙ্গার মালিগ্রাম ইউনিয়নের পাঁচকুল গ্রামে। তিনি তারাইল আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক।'