
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি কূটনীতিকদের আগ্রহ বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত ভোটকে সামনে রেখে ঢাকায় কর্মরত রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও বিশেষ দূতেরা নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তাদের প্রত্যাশা—নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক। সাম্প্রতিক সফর ও বৈঠকগুলোতেও সেই বার্তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নির্বাচনের পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিদেশি বিনিয়োগ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীরভাবে আগ্রহী।
অস্ট্রেলিয়া ও জার্মান মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক ঢাকা সফর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের ধারাবাহিক বৈঠক, কানাডা ও চীনের কূটনীতিকদের যোগাযোগ—সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মহল ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি।
অক্টোবর মাসে কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বিশেষভাবে দৃশ্যমান। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রী অ্যান অ্যালি ঢাকা সফর করে ‘অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ প্ল্যান ২০২৫–২০৩০’ উদ্বোধন করেন। একই সময়ে জার্মান উপমন্ত্রী জোহান সাথফ, সংসদ সদস্য বরিস মিজাতোভিচ ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরাও ঢাকায় ছিলেন। তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন।
২৩ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন শুধু দেশের নয়, আঞ্চলিক গণতন্ত্রের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটনের সফরেও আলোচনায় আসে আসন্ন নির্বাচন ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া নিশ্চিতের আহ্বান।
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, এসব সফরের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই তাদের অগ্রাধিকার।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার সম্প্রতি বলেছেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত সার্জিও গোর এবং চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনও নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, এসব বৈঠক তাদের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার অংশ।
কানাডার হাইকমিশনার অজিত সিং ও চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। চীন বিএনপি, জামায়াত ও নতুন দল এনসিপিকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যেখানে নির্বাচন ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে বিদেশিদের আগ্রহের মূল কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ নিরাপত্তা। তিনি বলেন, যদি ধারাবাহিকভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, বিদেশিদের তৎপরতা স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে।
সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, কানাডা, তুরস্ক ও সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের বৈঠক হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তি এনসিপির সঙ্গেও বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যোগাযোগ বেড়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর বাসায় তিন নর্ডিক দেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠকও আলোচনায় এসেছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, এসব বৈঠক কূটনৈতিক সৌজন্যেরই অংশ। তবে কূটনৈতিক মহলের ধারণা, বাংলাদেশের নির্বাচন যত দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যভাবে সম্পন্ন হবে, তত দ্রুতই বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।













