
বিশেষ প্রতিনিধি: মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির নামে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলায় মোট আত্মসাৎ ও পাচারের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। এর বাইরেও তাঁদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে।
গত ১১ মার্চ দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় (ঢাকা-১) থেকে পৃথক ১২টি মামলা দায়ের করা হয়। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন লোটাস কামাল, তাঁর স্ত্রী কাশমেরি কামাল, দুই মেয়ে কাশফি কামাল ও নাফিসা কামাল এবং সংশ্লিষ্ট ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক।
প্রতারণার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয় পরিবারভিত্তিক
সূত্র জানায়, জনশক্তি রপ্তানিই ছিল লোটাস কামালের প্রথম ব্যবসা। ক্ষমতার প্রভাব ব্যবহার করে তিনি এ খাতে পরিবারভিত্তিক প্রতারণার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তাঁর স্ত্রী এবং দুই মেয়ে সক্রিয়ভাবে এই ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন।
দুদকের অভিযোগ অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সময় প্রবাসীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার স্থলে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা আদায় করা হয়। শুধু মেসার্স অরবিটাল এন্টারপ্রাইজ থেকেই ৬ হাজার ২৯ জন কর্মীর কাছ থেকে ১০০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক লোটাস কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামাল।
১২ মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
প্রথম মামলায় লোটাস কামাল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১০০.৯৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ।
দ্বিতীয় মামলায় দুজনের বিরুদ্ধে ৫০.১৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার।
পরবর্তী ১০টি মামলায় পর্যায়ক্রমে আরও ৯৭৭.৪৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিং
লোটাস কামাল: সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২৭.৫২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ৪৪৬ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ।
কাশমেরি কামাল: স্বামীর যোগসাজশে ৪৪.১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ২৬.৬৪ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন।
কাশফি কামাল: পিতার সহায়তায় ৩১.৭৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ১৭৭.৪৮ কোটি টাকার ব্যাংক লেনদেন।
নাফিসা কামাল: বাবার সহায়তায় ৬২.১৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ১৯৯.২৩ কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ।
মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জাল
২০১৮ সালে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে ২০২১ সালে নতুন চুক্তিতে আবার কর্মী নেওয়া শুরু হয়, যেখানে ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু কার্যত নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ২০-২৫টি সিন্ডিকেট এজেন্সির হাতে—যার নেতৃত্বে ছিলেন লোটাস কামাল।
অভিযোগে বলা হয়, লোটাস কামালের পরিবারের মালিকানাধীন অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল নামে মালয়েশিয়াভিত্তিক কোম্পানির মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কাশমেরি কামাল হলেও ঠিকানা দেখানো হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
দুদকের বক্তব্য
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানান, “লোটাস কামাল ও তাঁর পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারে জড়িত। তাঁরা প্রতিটি শ্রমিকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা করে আদায় করেছেন।”