
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে বিদ্যমান ৪৩ মন্ত্রণালয় থেকে কমিয়ে ২৫টি এবং বিভাগের সংখ্যাও কমানোর সুপারিশ করেছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
সরকারের ব্যয় কমাতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও সচিবের সংখ্যা কমিয়ে ৬০ করারও সুপারিশ ছিল। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয় কমিশনের প্রতিবেদনে। কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সাধারণ সেবা খাতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সরকারের ব্যয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ খাতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি এবং সামনে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়া হলে এ ব্যয় আরো বাড়তে পারে। তবে ব্যয় বাড়লেও এ খাতের সংস্কার না হওয়ায় দেশের সাধারণ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি প্রশাসন, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, কর সংগ্রহ, ডাটা ব্যবস্থাপনাসহ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো পরিচালনায় প্রতি বছরের বাজেটেই বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। আর সে অর্থের একটা বড় অংশই ব্যয় হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়।
জেনারেল পাবলিক সার্ভিস বা সাধারণ সেবা খাতের আওতায় রয়েছে সরকারের গুরুত্বের শীর্ষে থাকা বেশ কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। সেগুলো হলো রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্ম কমিশন, অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, প্ল্যানিং ডিভিশন-২, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ সেবা খাতে ৪৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৩২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে সাত মাসে সরকারের ব্যয় বেড়েছে ১৫ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা।’
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু বেতন-ভাতা বাবদ চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ৩৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এছাড়া শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত এ খাতে সরকারের ব্যয় ছিল ১২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। ফলে এ খাতেও সরকারের ব্যয় বেড়েছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএনএম মঈনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি একক কোনো মন্ত্রণালয়ের নয়, এটা সার্বিক বিষয়। আর কিছু কিছু সংস্কার কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম শেষে রিপোর্ট দিলে সে অনুযায়ী এটি পরিচালিত হবে।’
দেশের জনপ্রশাসন ও শাসন কাঠামোয় বড় রকমের পরিবর্তনের জন্য বেশকিছু সুপারিশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সুপারিশমালা প্রণয়নের আগে জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত একটি জরিপ পরিচালিত হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন পরিচালিত ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৮৪ শতাংশের বেশি নাগরিক মনে করে দেশের জনপ্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন। ৮০ শতাংশের মত, দেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থা জনবান্ধব নয়। প্রায় ৬৯ শতাংশ নাগরিকের ধারণা, বিগত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতার অভাব ছিল। ৫৬ শতাংশ মানুষ মনে করে জনপ্রশাসনকে জনবান্ধব করার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ৪২ শতাংশের মতে, দুর্নীতিই হচ্ছে প্রধান বাধা। জরিপে অংশ নেয়া ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে, জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রধান কাজ জবাবদিহি নিশ্চিত করা। আর ৩৬ শতাংশের মতে, দুর্নীতি দূর করতে পারা হচ্ছে আসল কাজ। আর ৯৬ শতাংশ নাগরিকের অভিজ্ঞতা হচ্ছে জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল রিপোর্ট তৈরি করে জমা দেয়া। আমরা আমাদের কাজ করেছি। সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়ে সরকারই ভালো জানে।’
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুপারিশ করলেও এখন পর্যন্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। এমনকি সংস্কার কার্যক্রম শুরুরও কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এর জন্য দরকার বড় ধরনের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন ঐকমত্য দরকার যে যখন যারা ক্ষমতায় যাবে তারা কেউই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রশাসনকে ব্যবহার করবে না। এগুলো ছাড়া কোনোভাবেই বর্তমান প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বশেষ পে-স্কেল ঘোষণা হয় ২০১৫ সালে। ১৯৭৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট আটটি পে-স্কেল দেয়া হয়েছে। আর মহার্ঘ ভাতা (২০ শতাংশ) দেয়া হয়েছিল সর্বশেষ ২০১৩ সালে। এর আওতায় সর্বোচ্চ ৬ হাজার আর সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩০০ টাকা বেতন বেড়েছিল। তবে ওই সময় বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কর্তন করা হয়েছিল।
প্রতি বছর বেতন-ভাতা খাতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও এর পুরোটা ব্যয় হয় না। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রথমে এ খাতে ৮০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। যদিও পরে এ বরাদ্দ কমিয়ে ৭৭ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য ওই অর্থেরও পুরোটা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। আলোচ্য অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে সরকারের প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা।,
সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেনারেল পাবলিক সার্ভিস বলতে জনগণকে যত রকম সুযোগ ও সেবা (যাতায়াত, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, খাদ্য) দেয়া হয় সেটাকে বোঝায়। এর মধ্যে কিছু আছে প্রত্যক্ষ পাবলিক সার্ভিস, কিছু আছে পরোক্ষ। তবে এ খাতে বাজেট বাড়ছে কিন্তু মানুষের কাছে সুযোগটা যেভাবে পৌঁছার কথা সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না। যদি সেবা নিশ্চিত করা না হয়, যারা সেবা দেবেন তাদের যদি জবাবদিহির আওতায় আনা না যায়, মোরালি বুস্ট-আপ করা না হয়, তাহলে বেতন বাড়িয়ে অবস্থার কোনো উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘দেশে দুর্নীতি একটা স্বভাব হয়ে গেছে। কেউ অভাবের কারণে এসব করে এটা আমি মনে করি না। বেতনও বাড়াতে হবে, আর্থিক সুবিধাও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কঠোর অনুশাসনও প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে সরকারের খরচের হার বাড়বে কিন্তু জনগণের কোনো লাভ হবে না।’
জনপ্রশাসন কমিশন তাদের প্রতিবেদনে শতাধিক সুপারিশ করেছে। তবে বিভিন্ন সুপারিশ বিচ্ছিন্নভাবে পর্যালোচনা না করে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করাই সমীচীন হবে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের দেয়া প্রতিবেদনই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশ সেগুলোর সঙ্গে জনপ্রশাসনের সুপারিশের সমন্বয় করতে হবে। সমন্বিতভাবে যে সুপারিশ গৃহীত হবে সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জনপ্রশাসনের সংকট নিরসন হতে পারে।’
প্রশাসন রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ উল্লেখ করে সাবেক এ আমলা আরো বলেন, ‘সরকার গোটা রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার করতে চাচ্ছে। প্রশাসনও রাষ্ট্র ব্যবস্থারই অংশ, এটি বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। তাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমন্বিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে।’