ছেলেকে বিমানবন্দরে দিতে এসে আগুনে প্রাণ গেল বাবার

নিজস্ব প্রতিবেদক: শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল একমাত্র ছেলে মনিম জমাদ্দারের। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ফ্লাইট। ছেলেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে সোমবার সকালেই গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন বাবা মিরন জমাদ্দার (৫৫)। ওঠেন শাহজাদপুরের আবাসিক হোটেল সৌদিয়ায়। স্বজনকে বলতেন, জীবিত থাকতেই যেন ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে পারেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না মিরনের। গতকাল সোমবার সকালে গুলশান থানাধীন যে আবাসিক হোটেলে উঠেছিলেন, ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান তিনি। একই আগুনে ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দু’জন। তাদের স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শাহজাদপুরের আবাসিক হোটেল ভবনের দোতলায় বিউটি পার্লারে আগুন লাগে। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে হোটেলে। এতে প্রাণ হারান চারজন। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ধারণা করা হচ্ছে, বিউটি পার্লারের এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত।

পুলিশ বলছে, চারজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দু’জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। মিরন ছাড়া অপরজন হলেন নিউ ঢাকা হলিডেস ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিক ইসরাফুল আলম সজীব (৪০)। তিনি নদ্দা কালাচাঁদপুরে পরিবার নিয়ে বাস করতেন।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান ঘটনাস্থলে জানান, ভবনের দোতলার বিউটি পার্লারে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এর পর দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। দোতলা থেকে আগুন অন্য তলায় ছড়াতে পারেনি। এর আগেই দুপুর ১টা ৪ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। চারতলার টয়লেটে একজন এবং ছয়তলার চিলেকোঠায় দরজার সামনে তিনজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

তিনি বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, ওই তিনজন ছাদে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দরজা তালাবদ্ধ থাকায় তারা আটকা পড়ে ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে মারা যান। ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। এ ছাড়া আবাসিক হোটেলের লাইসেন্সও নেই। ভবনটিতে একটাই সিঁড়ি, সেটা সরু। আগুনের কারণ জানতে তদন্ত কমিটি করা হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার তারেক মাহমুদ সমকালকে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা চারজনের লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। হোটেলের মালিকপক্ষ এবং বিউটি পার্লারের মালিককে পাওয়া যায়নি। এ কারণে হোটেলে কতজন অতিথি ছিল, জানা সম্ভব হয়নি।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, ছয়তলা ভবনের ছাদের অর্ধেকাংশে দুটি কক্ষ করা আছে। সে হিসেবে সাড়ে ছয়তলা বলা যায়। দুই কক্ষের মাঝখানে চলার পথ এবং সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার দরজা। টিনের দরজায় তালা ঝুলছে। ভবনটির নিচতলায় ফার্নিচার ও ফটো স্টুডিও। দোতলায় গোল্ডেন টিউলিপ বিউটি লাউঞ্জ নামের বিউটি পার্লার। এ প্রতিষ্ঠানেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে প্রতিষ্ঠানের সব আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনতলা থেকে সাড়ে ছয়তলা পর্যন্ত হোটেল সৌদিয়া। বিদেশগামী যাত্রী এবং গ্রামের বাড়ি থেকে তাদের সঙ্গে আসা লোকজনই বেশি ওঠে এই হোটেলে।’

প্রত্যক্ষদর্শী নিচতলার প্লাস্টিক দরজা ব্যবসায়ী ওবাইদুর রহমান জানান, সকাল ১০টায় তিনি দোকান খোলেন। দুপুর ১২টার পর হঠাৎ রাস্তার লোকজন আগুন আগুন বলে চিৎকার করেন। তিনি দ্রুত দোকান থেকে বের হয়ে দেখেন, দোতলার বিউটি পার্লারে আগুন জ্বলছে। সেখান থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হচ্ছে। তিনিসহ স্থানীয় লোকজন আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রুবেল মিয়া জানান, দোতলা যখন জ্বলছিল, তখন হোটেলের তিনতলার বারান্দার কাচ ভেঙে কার্নিশ বেয়ে চারজনকে নেমে যেতে দেখেছেন তিনি।

নিহত মিরন জমাদ্দারের শ্যালক হিরন তালুকদার জানান, তাঁর ভগ্নিপতির বাড়ি পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার দারুলহুদা গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন সৌদিতে ছিলেন। আট বছর আগে দেশে ফিরে গ্রামে চাষাবাদ শুরু করেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে মনিম জমাদ্দারকে সৌদি আরবে পাঠানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর। প্রায়ই বলতেন, তিনি জীবিত থাকতে যেন মনিমকে বিদেশে পাঠাতে পারেন। এতে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা থাকবে না।

হিরন আরও জানান, মনিমের সৌদি আরবে যাওয়ার সব ব্যবস্থা ভগ্নিপতিই করেছিলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট ছিল। ছেলেকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সোমবার সকালে আমরা ঢাকায় এসে হোটেল সৌদিয়ার ৪০২ নম্বর কক্ষে উঠি। মনিম কয়েক দিন আগে ঢাকায় এসে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠে। হোটেলটি সে-ই ঠিক করে রেখেছিল। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হোটেলে ওঠে ঘুমিয়ে পড়ি।’

ঘুম থেকে ওঠার পর মিরন জানান, তিনি নাশতা করেছেন। আমাকে নাশতা করতে বাইরে যেতে বলেন। আমি নাশতা করে হোটেলের কাছে পৌঁছামাত্র দেখি আগুন জ্বলছে। দুলাভাইকে ফোন করলে তিনি বলেন, প্রচুর ধোঁয়া, শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাথরুমের মধ্যে অবস্থান করছেন। এর পরই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বাবার মৃত্যুর খবরে ছেলে মনিম ছুটে আসেন হোটেলে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি সমকালকে বলেন, আমাকে ঘিরে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। বাবাই চেয়েছিলেন আমি বিদেশ যাই। আমাকে বিমানবন্দরে এগিয়ে দিতে এসে প্রাণ হারাতে হলো তাঁকে। মঙ্গলবার সৌদি আরবে তিনি যাচ্ছেন না জানিয়ে বলেন, ফ্লাইটের তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে।

গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত)’ মোখলেসুর রহমান জানান, নিহত দু’জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ নিহতদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করেছে।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

খালেদা-ফখরুলের কী কথা হল’

নিজস্ব প্রতিবেদক: কারামুক্তির পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকালই প্রথম দেখা করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। গতকাল রাত ৮ টার দিকে

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ভদ্রঘাট ইউনিয়ন পরিষদে অতিরিক্ত ফি আদায়

নজরুল ইসলাম: সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ১নং ভদ্রঘাট ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু সনদ ও সংশোধনে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ উঠেছে সচিব নাজমুল হোসেন, প্যানেল চেয়ারম্যান

জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আ. লীগ নির্বাচনে যাবে : বাহাউদ্দীন নাছিম

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবেন নির্বাচন কমিশন আর রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্য

গভীর রাতে বোরখা পরে পালিয়েছেন ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি-সেক্রেটারি

নিজস্ব প্রতিবেদক: গভীর রাতে বোরখা পরে আবাসিক হল থেকে পালিয়েছেন রাজধানীর ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা। কোটা আন্দোলনকারী

বেলকুচিতে কৃষকের ঘরে আগুন, ১ গরু ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই

উজ্জ্বল অধিকারী, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে এক কৃষকের গোয়াল ঘরে আগুন লেগে একটি গাভি গরু ও ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। এ সময় একটি বাছুর অগ্নিদগ্ধ

হাসিনা-কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার প্রমাণ মিলেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। রোববার (২০ এপ্রিল) চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম