
অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের নেপথ্যে ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা
নিজস্ব প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও অস্থিরতা ও সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিসহ বিভিন্ন এলাকায় ইউপিডিএফের (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট) কার্যক্রম ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, চাঁদাবাজি ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এসব ঘটনার পেছনে সংগঠনটির মুখপাত্র মাইকেল চাকমার নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
অস্ত্র ও চাঁদার অর্থনীতি
নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইউপিডিএফ এখনো পার্বত্য শান্তিচুক্তির আওতায় জমা না দেওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র হাতে রেখেছে। পাশাপাশি সীমান্তপথে ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মিয়ানমার হয়ে নতুন অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হচ্ছে। এই অস্ত্র কেনার অর্থ আসে চাঁদাবাজি ও মাদক লেনদেন থেকে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সংগঠনটি পাহাড়ের ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও সাধারণ অধিবাসীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। অনেক সময় চিরকুট পাঠানো, হুমকি বা আলামত রেখে যাওয়ার মাধ্যমে চাঁদা দাবি করা হয়। এতে স্থানীয় মানুষ, এমনকি পর্যটকেরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ইউপিডিএফ গঠিত হয় এবং “পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন” দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হয় মাইকেল চাকমা ও শক্তিমান চাকমার বিরোধ।
২০১১ সালে র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের পর মাইকেল চাকমার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে, বিপরীতে জনপ্রিয়তা বাড়ে শক্তিমান চাকমার। পরবর্তীতে তিনি নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে।
২০১৮ সালের ৩ মে শক্তিমান চাকমা নিজ অফিসে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। পরদিন তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়া তপন জ্যোতি (বর্মা) ও সঙ্গীদের গাড়িবহরে হামলায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়। দুই ঘটনাতেই মাইকেল চাকমার নাম আসামি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
গুম, প্রত্যাবর্তন ও পুনরায় সক্রিয়তা
২০১৯ সালে মাইকেল চাকমা নিখোঁজ হন বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করে। সূত্র মতে, সে সময় সরকারের সঙ্গে মতবিরোধের জেরেই তাঁকে আটক করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর তিনি পুনরায় প্রকাশ্যে আসেন এবং ইউপিডিএফের নেতৃত্বে সক্রিয় হন। ফিরে এসে নিজেকে গুমের শিকার হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তাঁর বিরুদ্ধে নতুন করে বিভাজন ও অস্থিতিশীলতা তৈরির অভিযোগ উঠেছে।
মামলার তালিকা
স্থানীয় প্রশাসন ও তদন্ত সূত্রের তথ্যমতে, মাইকেল চাকমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১১টি নিশ্চিত মামলা রয়েছে। কিছু মামলার তথ্য নিচে দেওয়া হলো—
সাল এলাকা ও থানার নাম অভিযোগ মামলার অবস্থা
২০০৭ লংগদু, রাঙামাটি জেলেদের মারধর ও চাঁদাবাজি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার
২০০৭ ভাইবোনছড়া, রাঙামাটি খুন ও অস্ত্র চোরাচালান সেনা অভিযান পরিচালিত
২০১১ জুরাছড়ি নিরঞ্জন চাকমা হত্যা মূল আসামি
২০১১ সিএমপি, পাহাড়তলী ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগ গ্রেপ্তার
২০১৮ নানিয়ারচর শক্তিমান চাকমা হত্যা আসামি নং ৩৭
২০১৮ নানিয়ারচর তপন জ্যোতি (বর্মা) হত্যা আসামি নং ৩১
২০১৮ বাঘাইছড়ি সুরেন বিকাশ চাকমা হত্যা আসামি নং ৪
২০১৮ বাঘাইছড়ি বন কুসুম চাকমা হত্যা আসামি নং ৪
২০১৮ বাঘাইছড়ি মিশন চাকমা হত্যা আসামি নং ৩
শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা
বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রায় তিন দশক পরও যদি পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাণিজ্য ও সহিংসতার চক্র বন্ধ না হয়, তাহলে তা শুধু পাহাড়ের স্থিতিশীলতাই নয়—দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
তাঁদের মতে, মাইকেল চাকমার মতো বিতর্কিত ও মামলাভুক্ত নেতাদের আইনের আওতায় না আনা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।