
জেলা প্রতিনিধি, কুষ্টিয়া: শতাধিক হত্যা মামলার আসামি ও চরমপন্থী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর প্রধান কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল মেম্বারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুর একটার দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মুকুল খুন, গুম, চাঁদাবাজি, দখলদারি, ডাকাতি, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত৷ তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা রয়েছে।
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আন্দোলনকারী সবুজ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। চরমপন্থী সংগঠনের আঞ্চলিক শীর্ষ সন্ত্রাসী মুকুল মেম্বার কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুরাতন কুষ্টিয়া এলাকার মুসলিম বিশ্বাসের ছেলে। এই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিদেশে পলাতক কুষ্টিয়ার আব্দালপুর গ্রামের আলী রেজা সিদ্দিকী ওরফে কালুর নির্দেশে মুকুল বিভিন্ন সন্ত্রাসী অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন বলেন, বুধবার দুপুরের দিকে ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশের যৌথ অভিযানে মুকুল মেম্বার গ্রেপ্তার হন। তাকে হরিপুর বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা রয়েছে। সবুজ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর আগেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। পরে জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপর আবারও সে চাঁদাবাজি, দখলদারি, ডাকাতি সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়। তাকে রিমান্ডের জন্য আবেদন করা হবে।
৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী যুবলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন কুষ্টিয়া শহর যুবদল কর্মী সবুজ আহমেদ। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী রেশমা খাতুন বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলার আসামি মুকুল মেম্বার।
জানা গেছে, জাসদ গণবাহিনীর আদলে নিজ নামে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়া ইবি থানার আব্দালপুর গ্রামের কালু। বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে একের পর এক হত্যা, হাট-ঘাট দখল এবং অবৈধ অস্ত্র ও দলে নতুন নতুন ক্যাডার ভিড়িয়ে সে গড়ে তুলেছে নিজস্ব সাম্রাজ্য। কালুর নেতৃত্বে মুকুল মেম্বারের মাধ্যমে হরিপুর এলাকা, পদ্মা নদী ও গড়াই নদী সহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাতেন।
কুষ্টিয়া জেলাসহ ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, পাবনা, নাটোর এলাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী এই কালু। কালুর একাধিক নাম, বড় কালু ওরফে আলী রেজা ওরফে বুলবুল ওরফে কমল দা। কালু একাধিক মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তিনি বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে পলাতক থেকে লিপটন, রাজু, মুকুল সহ তার বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতাদের দিয়ে চাঁদাবাজি, দখলদারি, ডাকাতি, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা, হাট-ঘাট, বালু মহল, পদ্মা ও গড়াই নদীর চর দখল এবং বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কেউ কোনোভাবে বিরোধীতা করলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে হত্যার দায় স্বীকারোক্তি দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন চরমপন্থী সন্ত্রাসী কালু বাহিনীর লোকজন।
বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা কিছুদিন গা ঢাকা দেয়। কিছু দিন পরই তারা আবার বিএনপি নেতাদের আনুকল্য নিয়ে নানা অপকর্ম শুরু করে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেনী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় প্রতিপক্ষের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই হত্যার দায় স্বীকারোক্তি দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠায় কালু বাহিনী। এর ২১ বছর আগে (২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর) আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বের জের ধরে একই এলাকায় চরমপন্থী পাঁচ নেতাকে হত্যা করে কালু বাহিনী। এ মামলায় কালুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০০৯ সালের ৮ আগস্ট তিনজনকে হত্যা করে কুষ্টিয়া গণপূর্ত কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ব্যাগের ভেতর তিনটি মাথা ঝুলিয়ে রেখে যান কালু। ৯০ দশক থেকেই তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান ছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় শতাধিক খুনের মামলা রয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আলোচিত চরমপন্থী সংগঠনের শীর্ষ নেতা কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহাঙ্গীর কবির ওরফে লিপটনকে তিন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। কুষ্টিয়া দুর্বাচারা গ্রামে লিপটনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৬টি বিদেশি পিস্তল, ১টি লং ব্যারেলগান, ১০টি ম্যাগাজিন, ১৪০টি গুলি, ৮টি শিল্ড, ৬টি বল্লম ও অন্যান্য সরঞ্জাম সহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর রাজুকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে মুকুল মেম্বার কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে হাট-বাজার, বালু মহল, পদ্মা ও গড়াই নদীর চর দখল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সে প্রতিদিন একাধিক বার অডিও/ভিডিও কলে কালুর সাথে কথা বলতেন। মাঠ পর্যায়ের সার্বিক অবস্থা তাকে জানাতেন। এবং তার নির্দেশে বিভিন্ন হাট, বাজার, নদী, চর, বালুর ঘাট, টেন্ডার ইত্যাদি থেকে আদায়কৃত অর্থের নির্দিষ্ট অংশ কালুকে প্রেরন করতেন। বেপরোয়া হয়ে ওঠা মুকুল মেম্বারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।