
নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থ ও সময় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে চালু হওয়া চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইন প্রকল্প জ্বালানি খাতে নতুন দিগন্তের সূচনা করলেও এর কারণে চরম সংকটে পড়েছে দেশের ট্যাংকার শিল্প। পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি তেল সরবরাহ শুরু হওয়ায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে বহু ট্যাংকার জাহাজ। ফলে হাজারো শ্রমিক ও মালিকের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহণ শুরুর ফলে বিদ্যমান ১২০টি আন্তর্জাতিক মানের ট্যাংকার জাহাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়বেন এই খাতের কয়েক হাজার শ্রমিক।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল পরিবহণ ব্যয় হ্রাস, সময় সাশ্রয় এবং তেল চুরি রোধ করা সম্ভব হবে। ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই পাইপলাইন দিয়ে প্রতিদিন ৬ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে নারায়ণগঞ্জের ডিপোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমেও সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
প্রকল্পের ইতিহাস অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রকল্পটি ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকায় হাতে নেওয়া হলেও নানা জটিলতায় কাজ শেষ হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং ব্যয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকায়। পুরো ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইন চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত।
পাইপলাইনের সুফল নিয়ে যখন সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা আত্মবিশ্বাসী, তখন বিপরীতে শঙ্কায় ট্যাংকার মালিক ও শ্রমিকরা। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, প্রতিটি ট্যাংকার তৈরিতে ১৩ থেকে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। পাইপলাইন চালুর ফলে জাহাজ মালিকরা প্রত্যাশিত ট্রিপ পাচ্ছেন না। অনেকেই ব্যাংকঋণে দেউলিয়া হয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি বেকার হচ্ছেন হাজারো শ্রমিক।
সংগঠনের নেতারা আরও বলেন, পাইপলাইনের বিপুল রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, দুর্ঘটনার ঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভবিষ্যতে পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাদের দাবি, বছরে ১৫৮ কোটি টাকা খরচ করে ট্যাংকারে তেল পরিবহণ করলেও পাইপলাইনের রক্ষণাবেক্ষণে বিপিসির খরচ হবে প্রায় ৭৭৩ কোটি টাকা, যা জাহাজ পরিবহণ ব্যয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, “চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইনে এখন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে প্রায় ৪০টি ট্যাংকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সাগরে এখনো জাহাজের চাহিদা আছে। মালিকরা অন্যখাতে কাজ করতে পারবেন।” বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান বলেন, “সব ট্যাংকার একসঙ্গে বন্ধ হবে না। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে।”
সরকারি মহলের দৃষ্টিতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে নৌপথভিত্তিক ট্যাংকার শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার কীভাবে এই শিল্প ও সংশ্লিষ্ট হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়।