নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবা খাতে ঘুষের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ভূমি, বিচারিক সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বন্দর সেবা, সচিবালয়ে ফাইল নিষ্পত্তি এবং বিআরটিএ অফিসে ঘুষের হার পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে আগের তুলনায় গড় ঘুষের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সাধারণ জনগণের রাষ্ট্রীয় সেবাব্যবস্থার প্রতি আস্থা আরও হ্রাস পাবে এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনিক শৃঙ্খলাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সেবাগ্রহীতারা জানান, আগে কোনো কাজের জন্য যেখানে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হতো, বর্তমানে সেখানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, ঘুষ লেনদেনের এই প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন তদবিরচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদ মওকুফ, নতুন ঋণ অনুমোদন ও মামলায় জামিন পেতে ঘুষের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঘুষের এই চিত্র তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের আগে কোনো কাজের জন্য ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো, এখন সেই কাজেই ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে।”
একজন ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার জমির খতিয়ান সংশোধনের জন্য আগে ১৫ হাজার টাকা দিলেই হতো, এখন বলছে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা লাগবে। কিছু নতুন লোক এসেছে, যারা লোকদেখানো সহায়তার নামে মোটা অঙ্ক দাবি করছে।”
দুর্নীতির পরিসংখ্যান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বিচারিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতির উচ্চহার ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। ভূমি, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও বিআরটিএর মতো খাতেও দুর্নীতি ও ঘুষের মাত্রা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিঘ্নিত করছে।”
টিআইবি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০ দশমিক ২২ শতাংশ।
সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হলো:
ভূমিসেবা: ২,৫১৩ কোটি টাকা
বিচারিক সেবা: ২,৫১৩ কোটি টাকা
আইনশৃঙ্খলা সংস্থা: ২,৩৫৭.৫ কোটি টাকা
অন্যান্য ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ:
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন: ১,৩৫০ কোটি টাকা
স্থানীয় সরকার: ৮৪০.৯ কোটি টাকা
বিদ্যুৎ: ৩০৯.৬ কোটি টাকা
স্বাস্থ্য: ২৩৫.১ কোটি টাকা
শিক্ষা: ২১৩.৯ কোটি টাকা
দায়িত্বশীলদের অবস্থান
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, এসব বিষয়ে নিয়মিত অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং জবাবদিহিতার অভাব এসব দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “দুর্নীতি, ঘুষ ও তদবির বাণিজ্য রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেয়। ব্যবস্থা পরিবর্তন ছাড়া শুধু ব্যক্তিবদলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.