নিজস্ব প্রতিবেদক: গোপালগঞ্জের পৌর পার্কে বুধবার এনসিপির সমাবেশের আগে হামলা চালিয়ে মঞ্চের চেয়ার ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে দিনভর হামলা-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় গতকাল বুধবার রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চঘাট এলাকা। নিহত হন চারজন। ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। গতকাল আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শহরের বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। এ সময় হামলাকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন–গোপালগঞ্জ শহরের কোটালীপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৯), শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫), উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন তালুকদার (২৪)। এরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, নিহতদের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, চারজনের মৃতদেহ হাসপাতালে এসেছে। এ ছাড়া গুরুতর আহত তিনজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ সুমন বিশ্বাস নামে এক যুবক সেখানে ভর্তি হয়েছেন। তিনি পেশায় গাড়িচালক। তাঁর পেটে ও আঙুলে গুলি লেগেছে।
এনসিপি দাবি করেছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে গণঅভ্যুত্থান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি কায়দায় হামলা চালিয়েছে।
সকালে পুলিশের গাড়িতে আগুন, ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর এবং এনসিপির সভাস্থলে হামলার মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়। দুপুরে গোপালগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। মোতায়েন করা হয় বিজিবি। সন্ধ্যায় চারজনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ হলে এবং শহর অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে রাত ৮টা থেকে কারফিউ বলবৎ করা হয়। আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তা বহাল থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম দেশের কোথাও কারফিউ জারি করা হলো। এর আগে গত জুলাই আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে কারফিউ জারি করেছিল।,
বিকেলেই ঢাকা, মুন্সীগঞ্জসহ আশপাশের অন্তত সাতটি জেলা থেকে প্রায় এক হাজার ২০০ পুলিশ সদস্যকে গোপালগঞ্জে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বিকেলে বিভিন্ন সড়কে এনসিপির ডাকে অবরোধ শুরু হলে কয়েকটি জেলা থেকে রওনা হওয়া পুলিশ সদস্যরা পথে আটকা পড়েন। ফলে তাদের গোপালগঞ্জ পৌঁছাতে দেরি হয়।
সহিংসতার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ কর্মীদের জঘন্য কর্মকাণ্ড বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে না।
বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে। গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসী দোসররা হামলা চালিয়েছে দাবি করে জামায়াত বলেছে, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর তৎপরতা দেখা যায়নি।
এনসিপি আজ সারাদেশে বিক্ষোভ এবং রাজধানীর সব থানায় মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
এনসিপির ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি ঘিরে মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। গতকাল এনসিপি নেতারা গাড়িবহর নিয়ে শহরে ঢোকার আগেই সকালে উপজেলার উলপুর গ্রামে পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। ঘটনাটি জানার পর একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসান। পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে গোপালগঞ্জ সদরের বৌলতলী ইউনিয়নের কংসুর বাসস্ট্যান্ডে ইউএনওর গাড়িতে হামলা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে উত্তেজনার সূত্রপাত। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা চালান। ২০০ থেকে ৩০০ লোক লাঠিসোটা নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে এনসিপির সমাবেশস্থলে যান এবং চেয়ার ভাঙচুর ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। সে সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা আদালত চত্বরে ঢুকে পড়েন। একই সময়ে মঞ্চে ও মঞ্চের সামনে থাকা এনসিপির নেতাকর্মীরাও দৌড়ে সরে যান। পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান দ্রুত ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ ও এনসিপির নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যান। দুপুর ২টার দিকে কড়া নিরাপত্তায় সমাবেশস্থলে পৌঁছান এনসিপির নেতারা। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে তারা পুলিশ ও র্যাবের নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুর যাওয়ার পথে বেলা পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে হামলা শিকার হন। এনসিপির গাড়িবহর লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। বিকেল ৫টার দিকে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আখতার হোসেনসহ এনসিপি নেতারা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে উঠে গোপালগঞ্জ শহর থেকে নিরাপদে বের হন। এরপর তারা খুলনায় পৌঁছান। সেখানে রাত পৌনে ১০টায় সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা ঘটনার তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করেন।,
হামলার ঘটনার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন। এ সময় পুলিশ-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ছিল। তাদের (এনসিপি) বলা হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তারা সমাবেশস্থলে এসে দেখেন, পরিস্থিতি ঠিক নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, এনসিপির সমাবেশ শেষে পৌনে ৩টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরায় নেতাকর্মীরা টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সমাবেশস্থল থেকে ২০০ মিটার দূরে লঞ্চঘাট এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে এনসিপির নেতাকর্মী ও পুলিশের গাড়ি আটকে দেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও কয়েকশ লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে এনসিপির নেতাকর্মীদের ঘিরে হামলা চালান। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।,
দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলির শব্দে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। হাতবোমা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের বিকট শব্দ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে আতঙ্কে শহরের অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। সমাবেশ এলাকাসহ শহরের মূল সড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন দেওয়া হয়। পরে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা হামলাকারীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। হামলাকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করেছেন। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাদের পিছু হটানোর চেষ্টা করে।
এদিকে সংঘাতের ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে– এমন ধারণা করা হচ্ছিল। সামাজিকমাধ্যমেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উস্কানি দিয়ে আসছিলেন। আশপাশের জেলা থেকে গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গোপালগঞ্জে জড়ো হচ্ছিলেন বলে জানা গেছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল কিনা– তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে।
কারাগার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হামলা
বিকেলে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় সরকারি গাড়িতে আগুন এবং জেলারের বাসভবনে হামলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কারাগারের মূল ফটকে ভাঙচুর চালানো হয় এবং একটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হামলার কয়েকজন কারারক্ষী আহত হন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের বাসভবনে হামলা চালিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিকেল ৪টার দিকে জেলা প্রশাসকের বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে।,
জেলায় এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
গোপালগঞ্জ জেলায় কারফিউ জারি করায় আজ সকালে অনুষ্ঠেয় এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য জায়গায় পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গোপালগঞ্জ জেলায় স্থগিত ভূগোল (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার পরিবর্তিত সময়সূচি পরে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় ২০২৩ সালের ডিগ্রি (পাস) ও সার্টিফিকেট কোর্সের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আসিফ মাহমুদ
গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পরিস্থিতি তদারকি ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। সেখানে আরও ছিলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এদিকে গতকাল ফেসবুক পোস্টে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া লিখেন– ‘গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জীবন-মৃত্যুর মতো পরিস্থিতি না হলে সাধারণ জনগণ কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের ভেঙে দেওয়া হবে।’
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.