
রাজনীতির দৃষ্টিকাড়া আদর্শের বয়ান আর বড় বড় রাজনীতিকদের নিয়ে ফ্যান্টাসি চর্চার বদলে তরুণদের স্বপ্নের দিকে ফিরতে হবে গণমাধ্যমকে। নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝে উঠতে হবে। তাদের স্বপ্নের পথেই তৈরি হবে তারুণ্যবান্ধব সমাজ-রাষ্ট্র। এমন দৃষ্টিভঙ্গিই পারে দেশের ক্ষমতা আর নির্বাচনমুখী রাজনীতিকে বদলে জনকল্যাণমূলক করতে। যে কারণে কোনো আদর্শ বা মত-পথের অন্ধ অনুসরণ না করে প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনার রাজনীতিকে প্রমোট করাই হবে বর্তমান জটিল সংকট কাটানোর উপায়। যা সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে একমাত্র গণমাধ্যম।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, রাজনৈতিক আদর্শ বাদ দিয়ে কি সমাজ নির্মাণ হতে পারে?যে কোনো আদর্শ ধরেই তো তরুণদের আগাতে হয়। কেউ কেউ বলবেন, আজকের তরুণরা তো বিগড়ে গেছে। তাদের কোনো আদর্শ নেই। এক্ষেত্রে তাত্ত্বিক উত্তর হচ্ছে, আদর্শহীনতার মধ্যেই এক ধরনের আদর্শ থাকে। যে আদর্শহীনতার মধ্য দিয়ে তরুণরা তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায় সেটাই তাদের আদর্শ। হয়তো এর তাত্ত্বিক মডেল এখন অসংজ্ঞায়িত।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর জেন-জিদের পড়তে না পারা বাইনারি আদর্শবাদীরা তরুণদের ওপর প্রবলভাবে ক্ষিপ্ত ছিলেন। যাদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো মত বা আদর্শের অন্ধ অনুসারি। এরা আসলে প্রলয় শুরু হলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার দলে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের চরিত্র ভিন্ন হওয়া জরুরি। বিশেষ মতাদর্শের প্রতি অন্ধ হলে গণমাধ্যম নিজেই সামনে আগানোর পথ হারায়। ফলে সেই গণমাধ্যম ক্ষমতা আর ভোটমুখী রাজনীতির গতিপথ বদলাতে সক্ষম হয় না।
দেশ, সমাজ ও জনমুখী গণমাধ্যম ক্ষমতার বদল ঘটায় না, শুধু রাজনীতি রাজনীতি বিষয়ে প্রবল জনসচেতনতা তৈরি করে। জবাবদিহিতা আর গণআলোচনার সুযোগ তৈরি করে। ভিন্নমত প্রকাশ করে গণমাধ্যম সমাজে বিকল্প চিন্তা ও সমাধানের পথ তৈরি করে দেয়।যা রাজনৈতিক এজেন্ডাকে প্রভাবিত করে। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এতদিন কি দেশে ভালো সাংবাদিকতা হয়নি? দুর্নীতি, অনিয়মের হাজার হাজার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি?এক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, হয়েছে।
বিগত কয়েক দশকের ভালো সাংবাদিকতার ফলাফল হিসেবেই জনগণ দুর্নীতি, অপরাজনীতি সম্পর্কে দারুণভাবে সচেতন হয়েছে। ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠেছে, শক্তি সঞ্চয় করেছে। জনগণ এখন এসে বুঝতে পারছেন, নিজেদের জন্য, সন্তানদের জন্য ভালো সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র দরকার। সেজন্য দরকার ভালো রাজনীতি। যে ভালো রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে সম্মিলিত গণমাধ্যম। আর ভালো সাংবাদিকতাই পারে রাজনীতি বদলাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে।
সাংবাদিকরা যখন তথ্য যাচাই করে প্রকাশ করে তখন রাজনীতিকদের ভ্রান্ত বা ভুয়া বক্তব্য আর টেকে না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দুর্নীতি, অপশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুগুলোকে জনগণের সামনে নিয়ে আসে। ক্ষমতার জবাবদিহি তৈরি করে। ফলে রাজনীতিকরা ভীষণ চাপে পড়েন তাদের নীতি বদলানোর জন্য।প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ভোটারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়।
বিপরীত দিকে, সাংবাদিকতা দলীয়করণে ডুবে গেলে নিজেদের মধ্যেই বিভাজন বাড়ে। দলের পক্ষে থাকায় সেল্ফ সেন্সশিপ তৈরি হয়।ফলে সত্য প্রকাশ কঠিন হয়ে পড়ে। ভালো সাংবাদিকতার পতন ঘটে। জনগণ যখন গণমাধ্যমের তথ্যের প্রতি আস্থা রাখতে পারে না, তখন সাংবাদিকতার প্রভাব, সম্মান কমে যায়। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, গণমাধ্যম কার পক্ষে দাঁড়াবে? এক্ষেত্রে সঠিক উত্তর হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রায়োগিক বাস্তবতা বা ব্যবস্থাপনার পক্ষে। নতুন প্রজন্মের স্বপ্নের অভিমুখে।
ফের যদি প্রশ্ন আসে, নতুন প্রজন্মের তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। তাহলে উত্তর হচ্ছে, তাদের শিক্ষা মেরামতে নজর দিন, জবের ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য ঠিক করায় মনোযোগ দিন, ঘুষ-দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা করুন। যারা তরুণবান্ধব নন, সেসব রাজনীতিকদের না বলতে শেখান। রাজনীতির পোস্ট-আইডিওলজির ভাষ্য সেটাই। নতুন প্রজন্ম বা তরুণদের নিজের সন্তান মনে করতে দিন। এর চেয়ে বড় আদর্শ আর থাকতে পারে না। গণমাধ্যমকে আদর্শহীন এই আদর্শের পথেই চলতে হবে। তবেই বর্তমান সংকট কাটানো সম্ভব।











