
নিজস্ব প্রতিবেদক: ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ফলে বাবরের মুক্তিতে বাধা নেই।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি)। হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে বাবরের পক্ষে আইনজীবী শিশির মনির খালাস চেয়ে এ আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান। অন্য পাঁচজন আসামির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান।
এর আগে, গত ১৮ ডিসেম্বর ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া চোরাচালান মামলায় ফাঁসির সাজা থেকে খালাস পান বাবর।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান আটক করা হয়। এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। এর মধ্যে অস্ত্র চোরাচালান মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে বাবরসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। অস্ত্র আইনে করা অন্য মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয় একই আসামিদের।
হঠাৎ আলোচনায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। বর্তমানে বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে তা প্রতিবেশী মিয়ানমারসহ ভারতের সেভেন সিস্টার্সে (উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সাতটি রাজ্য) ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশে ফিরে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার আগে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনিডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তার এই বক্তব্যের পরেই হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লুৎফুজ্জামান বাবরকে নিয়ে আলোচনা চলছে। সেভেন সিস্টার্স হলো- ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয়। এই সাত রাজ্যকে একত্রে সেভেনে সিস্টার্স বলে।
অনেকেই মনে করেন, লুৎফুজ্জামান বাবর ভারত সরকারের কাছে একটা আতঙ্কের নাম। লুৎফুজ্জামান বাবর সেভেন সিস্টারে বিদ্রোহী দল বানিয়ে দিয়ে ভারতে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিলেন। চীন-পাকিস্তান মিলে ভারতকে যতটুকু ক্ষতি করতে পারেনি তার চেয়ে বেশি লুৎফুজ্জামান বাবর করতে পেরেছেন। ২০০৪ সালে তিনি ১০ ট্রাক ভর্তি অস্র-গোলাবারুদ, রকেটের লঞ্চার নিয়ে ভারতে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তখন তারা নিজেদের দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করে। অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয় মূল ভারত থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল। আর সেখানের আন্দোলনকারীদের ১০ ট্রাক অস্ত্র সরবরাহ করতে চেয়েছিলেন এই লুৎফুজ্জামান বাবর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করতে পারেননি।
১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন লুৎফুজ্জামান বাবর। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এইচএসসি পর্যন্ত। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো নেত্রকোনা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বাবর। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০০১ সালে লুৎফুজ্জামান বাবর নেত্রকোনার একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের পরপরই বিএনপি যখন সরকার গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন দলের ভেতরে অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে লুৎফুজ্জামান বাবর ‘গুরুত্বপূর্ণ কোন মন্ত্রণালয়ের’ দায়িত্ব পাবেন।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট বাংলাদেশে সরকার গঠন করার পর যে কয়েকজন ব্যক্তি প্রবল ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন, তাদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর ছিলেন অন্যতম। মনে করা হয় যে, বিএনপি নেত্রী এবং ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই ছিল বাবরের ক্ষমতাবান হয়ে উঠার মূল ভিত্তি। ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা মামলায় ১৮ মার্চ ২০১২ সালে তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবর সহ নতুন তালিকাভুক্ত ৩০ আসামির নাম যুক্ত হয়। ১ অক্টোবর ২০১৮ সালে এই মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ২০০৪ সালে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান মামলায় ৩ অক্টোবর ২০১০ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় শ্যেন অ্যরেস্ট দেখানো হয় বাবরকে। এই মামলায়ও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ২০০১-২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় যেসব ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন এবং সরকারের মধ্যে প্রবল অস্বস্তি তৈরি করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১০ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আটক করা হয় ২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল রাতে। দুটি বড় ট্রলারে করে এসব অস্ত্র সমুদ্রপথে আনা হয় চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার বা সিইউএফএল জেটিতে।
পর্যবেক্ষকদের অনেকই মনে করেন, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের সেই ঘটনা ভারতের সঙ্গে তৎকালীন বিএনপি সরকারের মধ্যে শীতল সম্পর্কের সূচনা করেছিল। দেশটির তৎকালীন কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন যে ভারতের চাপে পড়েই বিএনপি সরকার সেসব অস্ত্র আটক করে। অন্যথায় সেসব অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে যেত। বিএনপি অবশ্য বরাবরই দাবি করে করে যে সরকার তখন ব্যবস্থা নিয়েছিল বলেই সেসব অস্ত্র আটক করা হয়েছে। সরকার যদি চাইতো তাহলে সেগুলো ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে যেত। কিন্তু বক্তব্য যাই হোক, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর থেকে বিএনপি সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। ভারতের কর্মকর্তারা মনে করেন, এতো বড় আকারে না হলেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্ত্র ঢুকেছে। দশ ট্রাক অস্ত্র আটকের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে সেটি দেখিয়ে দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে সিইউএফএল জেটিতে এসব অস্ত্র খালাস হবার সময় পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সহায়তায় সেগুলো আটক করা হয়। উদ্ধার করা আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ছিল চীনের তৈরি একে-৪৭ রাইফেল, সেমি অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লঞ্চার, রকেট শেল, পিস্তল, হ্যান্ড গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য। এই অস্ত্র যখন গণনা করা হয় তখন দেখা গেল ১ হাজার ৭৯০টি বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র, সাড়ে ১১ লাখ গুলি, সাড়ে ৬ হাজার ম্যাগাজিন, ২৭ হাজার গ্রেনেড এবং ১৫০টি রকেট লঞ্চার। সেদিন দিবাগত রাত দুইটা থেকে ভোর ছয়টা এ উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তৎকালীন ডিসি (পোর্ট) আবদুল্লাহেল বাকি ও এসি (পোর্ট)। প্রায় ত্রিশজন পুলিশের সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা।
দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের আগে থেকেই বিএনপি সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। এর মূলে ছিল নিরাপত্তা ইস্যু। ভারত তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিল। ভারতের অভিযোগ ছিল দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিচ্ছে বিএনপি সরকার। এমন অবস্থায় দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে। তখন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন বীনা সিক্রি। তিনি বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের তৎকালীন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের ভেতরে বসে নানা কাজকর্ম করছিল। চট্টগ্রামে যখন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ধরা পড়লো তখন এসব ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন সরকারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসলো।’
দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা বিএনপি ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক চূড়ান্ত অবনতির দিকে নিয়েছিল কী না সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তখন কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, আমি মনে করিনা যে ঐ ঘটনাটাই চূড়ান্ত ছিল। এসব ঘটনা সম্পর্ককে এফেক্ট করেছে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে তারা চায়নি যে বিএনপি ক্ষমতায় থাকুক। এটা যদি একেবারেই এমন হতো যে সরকারি মদদে পুরোপুরি হচ্ছে তাহলে এরকম ঘটনায় দুজন লোয়ার র্যাংকিং পুলিশ অফিসার গিয়ে সেটা আটকে দিল। এটা কি হয়? এটা হয় না। কিন্তু সরকারের ভেতর কেউ কেউ হয়তো জড়িত ছিল। সেটা না হলে ঘটনা এতদূর এগুতে পারতো না।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফু্জ্জমান বাবর বলেছিলেন, চট্টগ্রামে আটককৃত ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার এবং নাশকতার জন্য আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কথা সরাসরি উল্লেখ না করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তারা যেহেতু এ সরকারের পতন ঘটাবে বলেছে তাতে এ বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা অস্ত্র আটকের ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেন।’