
অনলাইন ডেস্ক: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে। পাকিস্তান গতকাল রাতেও ২০টি স্থানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভারত।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে। পাকিস্তান গতকাল রাতেও ২০টি স্থানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভারত। এর পাল্টা জবাব দেয়ার কথাও জানিয়েছে নয়াদিল্লির সামরিক সূত্র। যদিও সর্বশেষ এ অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেনি ইসলামাবাদ। অব্যাহত সামরিক সংঘাতে দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষজন আতঙ্কে খাদ্য ও জরুরি সামগ্রী মজুদ করতে শুরু করেছে। অনেকে স্বজনদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাঙ্কারের খোঁজে ছুটছে। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িকও দেখা গেছে। দুই দেশই একে অন্যের বিরুদ্ধে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও কামান হামলার অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে, যা গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভারতের পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী গ্রামবাসী বৃহস্পতিবার রাত থেকে আতঙ্কে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। গোলাবর্ষণে বেশ কয়েকটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেকেই বাঙ্কারের খোঁজে ছুটছে। একই অবস্থা আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দাদেরও। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কায় লাহোরেও খাদ্য, ওষুধ ও রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার মজুদ করছে সাধারণ মানুষ। অতিরিক্ত দাম না রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সংঘর্ষের আবহে দুই দেশের জনগণের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় সামরিক উত্তেজনা বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। হামলার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে উভয় দেশ নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের ঘরোয়া ক্রিকেট লীগ আইপিএল ও পিএসএল স্থগিত করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাট রাজ্যের অন্তত ২০টি স্থানে পাকিস্তান টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভারত। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রাতে জম্মু ও কাশ্মীর, অমৃতসরসহ ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এতে স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি পাকিস্তান।
ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, গতকালের হামলাগুলোর অন্যতম লক্ষ্য ছিল কাশ্মীরের আওন্তিপোরা বিমানঘাঁটি। যা ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্রিয়তায় রক্ষা পেয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ টুইট করে বলেন, ‘জম্মুতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করছি।’
ড্রোন শনাক্ত করা হয়েছে জম্মু, সাম্বা, রাজৌরি, পাঠানকোট, অমৃতসর, জয়সলমীর, বর্মের ও পোখরান এলাকায়। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর কুপওয়ারা, পুঞ্চ, উরি, নওগাঁও ও হান্ডওয়ারা সেক্টরে ব্যাপক কামান ও গোলাবর্ষণের খবর মিলেছে। উত্তর ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোয় টানা দ্বিতীয় রাতের মতো ব্ল্যাকআউট ও সাইরেন বাজানোর ঘটনা ঘটেছে। অমৃতসরে পাঁচটি স্থানে অন্তত ১৫টি ড্রোন দেখা গেলে সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। ফিরোজপুরে একটি সশস্ত্র ড্রোন বেসামরিক বসতিতে আঘাত হানলে এক পরিবারের কয়েকজন সদস্য গুরুতর আহত হন। তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
এদিকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, বুধ ও বৃহস্পতিবার রাতে তাদের সামরিক পরিকাঠামোগুলোকে নিশানা করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি বলেন, ‘পাকিস্তান থেকে ৩০০-৪০০ ড্রোন পাঠানো হয়েছিল। লেহ থেকে শুরু করে গুজরাট পর্যন্ত ৩৬টি জায়গায় হামলা হয়েছে। ভারতীয় সামরিক বাহিনী অনেকগুলো ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।’ তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভারতে এ রকম কোনো হামলার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
কর্নেল সোফিয়া আরো বলেন, ‘পাকিস্তানের তরফ থেকে সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি চালানো হচ্ছে। এ গোলাগুলিতে কয়েকজন ভারতীয় সেনাসদস্য হতাহত হয়েছেন। ভারতে পাল্টা হামলায় পাকিস্তানের বড়সড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’ তবে ঠিক কতজন ভারতীয় সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ভ্যোমিকা সিং জানান, ৭ মে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ যখন বিনা প্ররোচনায় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, তখনো তারা বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করেনি। এর অর্থ হলো পাকিস্তান বেসামরিক বিমানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
এদিকে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর ডিজি লে. জেনারেল আহমেদ শরীফ এক বিবৃতিতে ভারতকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের যদি পাকিস্তানের গুলি খাওয়ার এতই শখ করে থাকেন, তবে আমরা সেই ইচ্ছা পূরণ করব—আমাদের নির্বাচিত সময়, স্থান ও পদ্ধতিতে। তারা দাবি করছে যে পাকিস্তান হামলা করেছে। ভারত কি একটি হলেও পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান বা ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে পারবে? আহমেদ শরীফ চৌধুরী জানান, ভারতের সঙ্গে তারা উত্তেজনা হ্রাস করবেন না। ভারত তাদের যে ক্ষতি করেছে সেটির জন্য তাদের পাল্টা জবাব পেতে হবে।’
এদিকে ভারতের মোট ৭৭টি ড্রোন ধ্বংসের দাবি করেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদ বলছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৯টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়। তারপর গতকাল ৪৮টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে।
পেহেলগামে হামলার পর থেকেই পাকিস্তান-ভারত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) তীব্র গোলাগুলিতে জড়ায় দুই দেশ। গতকালও গোলাবর্ষণের মাত্রা আরো তীব্র হয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের গোলাবর্ষণে এক নবজাতকসহ প্রাণ হারিয়েছে পাঁচজন।
এদিকে ভারত-পাকিস্তান চলমান সামরিক উত্তেজনা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চান এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হোক। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ‘মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জানিয়েছেন, তিনি চান পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হোক।’ ক্যারোলিন আরো বলেন, ‘ট্রাম্প বুঝতে পারেন যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বহু দশকের বৈরিতা রয়েছে, যা তার প্রেসিডেন্সির আগেই শুরু হয়েছে। তবুও তিনি দুই দেশের নেতার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তিনি সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সচেষ্ট।’