
ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: ড.ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস মেয়াদ পার হয়ে গেছে। কিন্তু সরকারের ভেতরে নানা রকম টানাপোড়েন এবং অনৈক্য ক্রমশ প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি’। তাঁরা তাঁদের ফেসবুকের প্রোফাইল লাল করেছেন নতুন করে। এটি নিয়ে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন কি সাজানো নাটক নাকি সত্যি তা নিয়ে এখন বিভিন্ন মহলে নানামুখী আলোচনা। নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সরকারের ভেতরও নানারকম টানাপোড়েনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি নতুন নির্বাচনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণপিন্থ ইসলামী দলগুলো তাঁদের শক্তি নতুন করে প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সরকারের ক্ষমতা বলয়ে চলছে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাকেন্দ্রের শক্তি পরীক্ষার মঞ্চ প্রস্তুত।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন যে তাঁদের নিয়োগকর্তা হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। যারা গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর এই কারণেই প্রথম দফায় যখন উপদেষ্টামণ্ডলী গঠিত হয় তখন উপদেষ্টামণ্ডলীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম দফায় বলা হয়েছিল যে সবগুলো মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের মতামত এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতেই দেশ পরিচালিত হবে। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে তত দেখা যাচ্ছে যে এটি একটি সুশীল সরকার হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের একটা সুস্পষ্ট দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তবে এই দূরত্ব চরম আকার লাভ করে তৃতীয় দফায় যখন উপদেষ্টামণ্ডলীর কলেবর বাড়ানো হয়। তিনজন উপদেষ্টার মধ্যে একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, যাঁকে ড. ইউনূস ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বাকি একজন ব্যবসায়ী এবং অন্যজন সংস্কৃতিকর্মী। এই দুজনের নিয়োগ নিয়ে সারা দেশ জুড়ে তোলপাড় চলছে। এই নিয়োগের পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সারজিস এবং হাসনাত আবদুল্লাহ দুইজনই প্রতিবাদ করেছেন।
প্রশ্ন উঠছে, যদি সত্যি সত্যিই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা শিক্ষার্থীরাই এই সরকারের নিয়োগকর্তা হয়, তাহলে নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া এই দুজন উপদেষ্টাকে কে নিয়োগ দিলো? এই দুজন উপদেষ্টাকে নিয়েই চলছে নানা সমালোচনা। তাঁদের অতীত অনুসন্ধান চলছে। এই দুজন উপদেষ্টাই প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার গ্রুপের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। দুজনকে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন প্রভাবশালী সদস্যের হাত আছে-এমন গুঞ্জন বাজারে চালু আছে। এর ফলে স্পষ্টতই জুলাইয়ের আন্দোলনের শক্তি এখন বিভক্ত হয়ে পরেছে। তাঁরা এখন পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি যতটুকু না কাজ করেছেন তাঁর চেয়ে বেশি বড় করে দেখানো হয়েছে প্রথম আলো গ্রুপের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। প্রথম আলো মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে, যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গৃহপালিত শিল্পী কলাকুশলী, নির্মাতা পোষা হয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাঁদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিও বটে। আর এ কারণেই প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের আশীর্বাদপুষ্ট মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নিয়োগ যেমন ইসলামী দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ভালোভাবে নেয়নি, তেমনই অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর ভূমিকার প্রশ্ন তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু কিছু নেতাও এ নিয়ে মাঠ গরম করছে।
অন্যদিকে সেখ বশির কদিন আগে ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘বিজনেসম্যান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ডেইলি স্টার, প্রথম আলো গ্রুপের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। আর সেজন্যই তাঁকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে আনা হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। এর ফলে উপদেষ্টামণ্ডলীর একক নিয়ন্ত্রণ এখন প্রথম আলো, ডেইলি স্টার গ্রুপের হাতে। এই উপদেষ্টামণ্ডলীর অর্ধেকের বেশি সদস্য প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের গ্রুপের একান্ত আপনজন এবং তাঁদের ঘরানার লোক। যখন প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারকে ‘ভারতের দোসর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে এবং তাঁরা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবার পুনর্বাসন করতে পারে বলে দক্ষিণপপন্থি চিন্তকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, সেই সময় দুইজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিয়ে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার প্রমাণ করে দিল যে ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁরাই শক্তিশালী। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত সংহত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ফলে এটি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একাধিক বিশ্লেষক মনে করছেন সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার নিয়ন্ত্রিত উপদেষ্টামণ্ডলী এখন আর ছাত্রদের কথায় কান দিতে চান না। ছাত্রদের কিছু বিষয় তাঁরা বাড়াবাড়ি মনে করেন। এই বাড়াবাড়ি থামানোর জন্য তাঁদের মধ্যে এক ধরনের প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতা কেন্দ্রে এক এগারোর যে সুশীল বুদ্ধিজীবীদের শক্তি, তাঁরা এখন মূল নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাঁরা জানে যে সাধারণ জনগণের মধ্যে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা খুবই কম। শিক্ষার্থীদের শক্তি তাঁদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি যে আবেগ এবং সহানুভূতি গত জুলাই-আগস্ট মাসে সাধারণ মানুষের ছিল তাতে এখন ভাটার টান। কোন কোন ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন তৎপরতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো এই সুযোগটিই নিয়েছে। তাঁরা আস্তে আস্তে শিক্ষার্থীদের উপর নির্ভরতা কমাতে চায়। এখানেই শিক্ষার্থীদের সাথে সরকারের বিরোধ। সরকার না বলে বলা যায় যে, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের যে প্রভাবশালী গ্রুপটি সরকারের মধ্যে রয়েছে তাঁদের সাথে শিক্ষার্থীদের সুস্পষ্ট একটা বিরোধ এখান থেকেই তৈরি হয়েছে। আবার সরকারের মধ্যে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরও একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। এরা প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের উদার বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। ফরহাদ মজহার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই বুদ্ধিজীবীদের গুরু হলেন আবার ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলম। যিনি এখন উপদেষ্টা, কিন্তু তাঁকে কোন দপ্তর দেওয়া হয়নি। তিনি উপদেষ্টা হয়ে বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে নিজেকে একজন বিপ্লবী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন। যদিও তাঁর এই কাজটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা এই নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু আগস্টের অভ্যুত্থানের পর যেভাবে ভারতবিরোধী ইসলামপপন্থি শক্তির দাপট ছিল, সেই দাপট আস্তে আস্তে কমে যেতে শুরু করেছে। আর এই কারণেই তাঁদের মধ্যে হাহুতাশ। তাঁরা এখন ফারুকী এবং সেখ বশিরকে নিয়োগকে ইস্যু করে মাঠের অবস্থা উত্তপ্ত বলে অনেকের ধারণা।’
এখানে অবশ্য একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, জামায়াত বিষয়টিতে এখন পর্যন্ত একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থানে। তাঁরা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার নীতি গ্রহণ করেছে। তাঁরা এখন পর্যন্ত সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলছে না। বরং লন্ডনে সফররত জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন যে, এই ধরনের নিয়োগের আগে অবশ্যই যাচাই বাছাই করা উচিত। অন্যদিকে বিএনপি এখন ক্ষমতাকেন্দ্রে চতুর্থ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইতিমধ্যেই গত তিন মাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিএনপি একটি সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল একটি আবেগ উচ্ছ্বাসের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণজাগরণ। যে জাগরণ এখন থিতিয়ে পড়েছে। কিন্তু বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি অত্যন্ত প্রবল। আর এই কারণেই বিএনপি এখন বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছে। সরকারের সঙ্গে বিএনপির মতপার্থক্য এবং দূরত্ব এখন স্পষ্ট। সামনের দিনগুলোতে নির্দিষ্ট করে বললে ডিসেম্বরের মধ্যে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের ঘোষণা না দেয় তাহলে বিএনপির যে চুপচাপ বসে থাকবে না সেটিও স্পষ্ট। এ রকম বাস্তবতায় একদিকে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার নিয়ন্ত্রিত সুশীল সমাজ, অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, দক্ষিণপপন্থি ইসলামিক রাজনৈতিক দল, অ্যাক্টিভিস্ট, বুদ্ধিজীবী এবং বিএনপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক শক্তি- এই চার শক্তি এখন ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি নিরঙ্কুশ করার জন্য মরিয়া। এই চেষ্টার ফলে তাঁদের দ্বন্দ্ব এবং মতপার্থক্যগুলো প্রকাশ হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপে বেশ সমালোচনা মুখরও হয়ে উঠছে। এরকম বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটুকু স্বস্তির মধ্যে দিন কাটাবে সেটি যেমন দেখার বিষয়, পাশাপাশি এই দ্বন্দ্ব অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টি করবে কিনা সেটিও দেখতে হবে।’