
মহান আল্লাহ তায়ালার সত্তা-পাক ও পবিত্র। প্রকৃতিগত আকাঙ্ক্ষা হলো মহান বরের নৈকট্য লাভ করে তার পবিত্র সত্তার মাঝে নিজেকে মিটিয়ে দেয়া। কুরবানীর গভীর তত্ত্ব খুবই সূক্ষ্ম। সমগ্র উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্যে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষনা করেন-
আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।(সূরা হাজ্জ্ব:৩৪)
এছাড়াও মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ নিশ্চয়ই আমার নামাজ,আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির জন্য।(সূরা আন’আমঃ১৬২)
অতএব কুরবানির জন্তু যেমন আল্লার হুকুম পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে নিয়ে আপন আপন অস্ত্বিত্বকে ফানা করেছ। মানুষের শরীরের টুকরো হচ্ছে তেমনি আমরাও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে অবনত মস্তকে তার পূর্ণ আনুগত্য করি।
কুরবানী পরিচিতিঃ
কুরবানী শব্দটা আসলে কিরবানুন শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে,কিরবান বলা হয় এমন বস্তুকে যা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যম বা উসিলা হয়।
কিন্তু সাধারণের মধ্যে কুরবান শব্দটি যবাই জন্যই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এছাড়াও মহা গ্রন্থ আল কোরআনে প্রায়ই এই শব্দ দ্বারা জন্তুর মাধ্যমে মহান রবের নৈকট্য অর্জন বুঝানো হয়েছে। যেমনঃ اذ قربا قربانا (মায়িদা-২৭)
সুতরাং শরীয়তের পরিভাষায় কুরবানি হলোঃ মহান রবের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ব্যাক্তির, নির্দিষ্ট পশু জবাই করার নাম কুরবানী।
কুরবানির নিসাবঃ
নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
(আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)
কুরবানি যাদের উপর ওয়াজিবঃ
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক জ্ঞানসম্পন্ন, বালেগ, মুক্বীম, (মুসাফির নয়,এমন) ব্যক্তির উপর কুরবানি করা ওয়াজিব।
যেমনঃ রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, “হে লোক সকল! জেনে রেখো,প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রতিবছরই কুরবানী ওয়াজিব। (আবূ দাউদ,পৃ.৩৮৫)
যতদিন সে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক থাকবে ততদিন প্রতিবছরই কুরবানী করতে হবে। তবে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্যে নিসাব পরিমাণ মাল সারাবছর থাকা জরুরি নয়; বরং ১০ই জিলহজ্জ ফজর হতে ১২ই জিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে। এ সময়ের মধ্যে কোন মহিলা যদি উক্ত পরিমাণ মালের মালিক হয়,তা হলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। ( শামী,৯ম খন্ড, পৃ.৪৫৭/হিদায়া৪র্থ খন্ড, পৃ.৪৪৪)
কুরবানীর পশুর বয়সসীমাঃ
উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬
কুরবানির ফজিলতঃ
১- নবী কারীম সাঃ ইরশাদ করেন, তোমরা মোটাতাজা পশুর কুরবানী কর, কারণ এটা পুলসিরাতে তোমাদের সাওয়ারী হবে। (কামযুল উম্মাম)
২-এক হাদীসে এসেছে, পশুর পশুর রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার পূর্বেই কুরবানীদাতার গত জীবনের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
৩- অন্য এক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাঃ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কুরবানী করবে, সে পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকি পাবে। (তিরমিজি-১৮০/১)
৪- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবী কারীম সাঃ মদীনার ১০বছর জিন্দেগীর প্রতিটি বছরই কুরবানী করেছেন। (তিরমিজি -১৮১/১)
৫- এছাড়াও যারা কুরবানী দেয়না তাদের বিষয়েঃ
#হজরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাঃ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করে, সে যেন ঈদগাহের নিকট না যায়। (ইবনে মাজাহ ২২৬,মুসতাদরা২ঃ৩৮৭)
কুরবানীর হিকমত বা রহস্য সমূহঃ
আসলে কুরবানীর হিকমত বা রহস্য রয়েছে অনেক,নিম্নে কিছু রহস্য তুলে ধরা হলঃ
ক) কুরবানী শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি কার্যকর উসিলা। কেননা মুশরিকদের মধ্যে জানোয়ার পূজার রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ইসলাম মুসলমানদের কুরবানীর বিধান দিয়ে তাওহীদ বিশ্বাসকে উজ্জ্বল ও মজবুতীয়তের পাশাপাশি এ শিক্ষা দেয় যে, এ জীব-জানোয়ার পূজার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, বরং কুরবানী করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। এর দ্বারা এক দিকে যেমন তাওহীদের বিশ্বাস শানিত হয়,অপরদিকে মুশরিকদের প্রতিও কার্যত এমন করা হয় যে,তোমরা তোমাদের এহেন উপাসনা ছেড়ে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়ে যাও।
খ) আল্লাহ তায়ালা যে সকল পশুকে আমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন এবং উহাদের দ্বারা আমাদেরকে নানা উপকার লাভের সুযোগ দান করেছেন তার শুকরিয়া আদায় করা হয় কুরবানির মাধ্যমে।
গ) আল্লাহর দীনকে বিশ্বে বিজয়ী করতে অনেক অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে “কিতাল’ বা সম্মুখ অশ্রযুদ্ধেও এগিয়ে যেতে হবে মুসলমানদেরকে। দুশমনদের রক্তপ্রবাহের সময় আসবে অনেক। সে ক্ষেত্রে মুসলমানগণ রক্তস্রোত দেখে যাতে ভয়ে প্রকম্পিত বা বিচলিত না হয়ে না যায়। কুরবানী তার-ও একটা প্রশিক্ষণ বলা যেতে পারে নিঃসন্দেহে।
সর্বোপরি কুরবানির দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ এবং প্রার্থীব জীবনের ভালোবাসা ইত্যাদি হতে পরিশুদ্ধ অর্জন করা হয়ে থাকে।(কুরবানির ইতিহাস,পৃ.৩২ও ৩৩)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যথাসময় যথাযথভাবে কুরবানী করার তাওফিক দান করুন, #আমিন।
বিঃদ্রঃ ইনশাআল্লাহ আগামীতে কুরবানির মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করা হবে।(অপেক্ষায় থাকুন)