কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের নির্মিত নয়তলা বাণিজ্যিক ভবনের শতাধিক দোকান বরাদ্দে ভয়াবহ অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কে ৪১ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ‘কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ টাওয়ার’-এর অধিকাংশ দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মী, তাদের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা—যাদের অনেকেই এখন পলাতক।
২০১৮ সালে নির্মাণ শুরু হওয়া এই ভবনের প্রতি ফ্লোরে রয়েছে ১৮ হাজার বর্গফুট জায়গা। প্রথম থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত শপিংমল, পঞ্চম তলায় জেলা পরিষদের নিজস্ব কার্যালয়, ষষ্ঠ তলায় বিআরবি গ্রুপ এবং সপ্তম-অষ্টম তলায় রয়েছে হানিফের স্ত্রী ফৌজিয়া আলমের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্রতিষ্ঠান।
বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকায় ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও তৎকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম একাই নিজের, ছেলেমেয়েদের, জামাই ও আত্মীয়দের নামে নিয়েছেন অন্তত ১০টি দোকান। শিল্পবিষয়ক উপকমিটির সাবেক সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা নিয়েছেন ৬টি, শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি তাইজাল আলী খান ও তার পরিবারের নামে ৭টি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান আত্মীয়দের নামে নিয়েছেন ৪টি দোকান।
দলীয় নেতাদের স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়দের নামে অর্ধশতাধিক দোকান বরাদ্দের তথ্য পাওয়া গেছে।
বরাদ্দে আরও রয়েছেন:
শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা
কুষ্টিয়া-২ আসনের সাবেক এমপি কামারুল আরেফিন
জেলা যুবলীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল ইসলাম স্বপন
ভেড়ামারা পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু হেনা মোস্তফা কামাল
জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক তরিকুল ইসলাম মানিক
স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ ও জাসদ নেতাসহ একাধিক সহযোগী সংগঠনের নেতারা
জেলা পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তা, যেমন সদ্যবিদায়ী সহকারী প্রকৌশলী রুহুল আজম ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান এবং একাধিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও আত্মীয়দের নামে দোকান নিয়েছেন।
চূড়ান্ত বরাদ্দের গোপন প্রক্রিয়া
বলা হচ্ছে, দোকান বরাদ্দে কোনো প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। বরং গোপনে তালিকা তৈরি করে ক্ষমতাসীনদের পছন্দের লোকদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, দোকানপ্রতি বাজারমূল্য যেখানে ৫০-৮০ লাখ টাকা, সেখানে মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা জমা দিয়েই বরাদ্দ পেয়েছেন তারা। বাকি টাকা তিন বছরের কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুকুল কুমার মৈত্র বলেন, “দোকান বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলমান। চূড়ান্ত বরাদ্দ দেওয়া হবে তাদেরই, যারা পুরো অর্থ জমা দিয়েছেন।” তবে পলাতক নেতাদের নামে কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্তের আশ্বাস দেন তিনি।
বঞ্চিত সাধারণ ব্যবসায়ীরা
সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা দোকানের জন্য আবেদন করেও বরাদ্দ পাননি। দোকান বরাদ্দে আবেদনপত্র জমা নেওয়া হয়নি, বরং ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজনের নামেই তালিকা তৈরি হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ইয়াসিন আলী বলেন, “দোকান বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। বিশেষ করে মহিলাদের নামে বরাদ্দকৃত অধিকাংশ দোকানই আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবারের।”
হরিলুটের সূত্রপাত এবং দুর্নীতির তদন্ত
২০১৭ সালে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা হাজী রবিউল ইসলাম। তার সময়েই শুরু হয় দোকান বরাদ্দ ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে লুটপাট। অভিযোগ রয়েছে, ৫ বছরে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সূত্র বলছে, জেলা পরিষদের জায়গা, বরাদ্দ ও আর্থিক লেনদেন ঘিরে ভয়াবহ অনিয়ম ঘটেছে, যার নেপথ্যে ছিলেন মাহবুবউল আলম হানিফের ঘনিষ্ঠজনেরা।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.