নিজস্ব প্রতিবেদক: কিশোরগঞ্জে ৬৪টি মন্দির ও সংগঠনের তালিকা দেখিয়ে ডিসির বরাদ্দের ১০০ টনের বেশি চাল আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। তালিকায় নামের পাশে একটি সংগঠন ছাড়া আর কোনোটির ফোন নম্বর দেওয়া হয়নি। পূজা শেষ হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের কাছে সদর উপজেলার মন্দির ও সংগঠনের এই ভুয়া তালিকা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে তুলে নেওয়া হয়েছে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের চাল।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৩৬৫টি মন্দির ও মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিটি পূজার জন্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার আধা টন চাল বরাদ্দ দেয়। মন্দির বা মণ্ডপভিত্তিক কমিটিগুলো এসব চাল পূজার আগেই উত্তোলন করে। কিন্তু পূজার জন্য মন্দির বা মণ্ডপ কমিটি ছাড়া আলাদা কোনো সংগঠনকে চাল দেওয়া হয় না।
বরাদ্দের তালিকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নিজ নিজ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও)। কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই চাল উত্তোলন করা হয়। কিন্তু পূজার পর জেলা প্রশাসনের কাছে সদর উপজেলার ৬৪টি মন্দির ও সংগঠনের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকায় মাত্র ১৫টি মন্দিরের নাম থাকলেও শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ সম্প্রদায়, বাংলাদেশ ছাত্র গণজাগরণ মঞ্চ, শ্রীশ্রী শ্যামা সংঘ, হরিজন সমাজকল্যাণ সংঘসহ ৪৯টি সংগঠনের নাম রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এসব নামে কোনো সংগঠন নেই।
তালিকায় দেখা গেছে, মোট ১০০ টন ৫০০ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি মন্দির ও সংগঠনের নামের পাশে এক টন থেকে দুই টন চাল বরাদ্দ লেখা রয়েছে। দেখা গেছে, একটি মন্দিরের বরাদ্দ লেখা আছে এক টন আবার একটি সংগঠনকেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই টন। অথচ পূজার সময় প্রত্যেক মন্দির ও মণ্ডপকে দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৫০০ কেজি চাল! পূজা সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর একেকটি মন্দির আর সংগঠনকে দ্বিগুণ, চার গুণ চাল কী কারণে দেওয়া হলো, এই প্রশ্ন উঠেছে। এসব চাল বাজারে ৪০ হাজার টাকা টন দরে বিক্রি করা হয় বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতা ও চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। সেই হিসাবে মোট ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকার চাল উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে দু’চারটি মন্দির-সংগঠনকে চালের তথ্য গোপন রেখে আর্থিক অনুদানের কথা বলে কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি প্রায় ৪০ লাখ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।'
তালিকায় দেখা গেছে, শহরের বিন্নগাঁও এলাকারই আটটি সংগঠনের নাম রয়েছে। কিন্তু বিন্নগাঁও এলাকার ব্যবসায়ী সুমন পাল ও চন্দন রায়কে এসব নাম দেখালে তারা এমন কোনো সংগঠনকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন। শহরের বত্রিশ এলাকারও আটটি সংগঠনের নাম তালিকায় রয়েছে। কিন্তু বত্রিশ এলাকার একটি মন্দিরের পূজারি সুবল দাস এসব নাম দেখে কোনো সংগঠনকেই চিনতে পারেননি। তাঁর মন্দিরের নামও ওই তালিকায় নেই।'
তালিকার চার নম্বর ক্রমিকে নাম রয়েছে শহরের বত্রিশ এলাকার হরিজন কলোনির হরিজন সমাজকল্যাণ সংঘের। পাশে সংগঠনের সভাপতি বাবু হরিজনের নাম, মোবাইল ফোন নম্বর এবং এক টন চালের কথা উল্লেখ আছে। বাবু হরিজনকে প্রশ্ন করলে জানান, তারাও কলোনিতে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। পূজার সময় শুধু ৫০০ কেজি চাল পেয়েছিলেন। এর পর আর কোনো বরাদ্দ পাননি, এ বিষয়ে কিছু জানেনও না।
সদর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ সরকার জানান, এবার উপজেলায় ৫৭টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছে। তখন প্রতি মণ্ডপে ৫০০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। কিন্তু এবার তালিকায় স্থান পেয়েছে ৬৪টি মন্দির ও সংগঠন! এই তালিকায় তাঁর পরিচালনায় বিন্নাটি এলাকার বীরেন্দ্র সরকারের বাড়ির পূজা মণ্ডপের বিপরীতে এক টন চাল বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। তবে তাঁকে দেওয়া হয়েছে নগদ ১০ হাজার টাকা। সদর উপজেলার অন্য কোনো মন্দির বা সংগঠনকে কোনো চাল বা টাকা দেওয়া হয়েছে কিনা, তাঁকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।'
এ ব্যাপারে সদর উপজেলার পিআইও (প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা) মো. শহীদুল ইসলাম জানান, তাঁর কাছে জেলা প্রশাসকের বরাদ্দপত্র পাঠানো হয়েছে। সেই অনুযায়ী তিনি চালের ছাড়পত্র দিয়েছেন। এর বাইরে তাঁর কিছু জানা নেই। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমানকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ১০০ টন ৫০০ কেজি চাল বরাদ্দের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নারায়ণ দত্ত প্রদীপ বরাদ্দ নেওয়ার পর তাঁর অফিস থেকে পিআইও অফিসের মাধ্যমে এসব চালের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। সংগঠনগুলো ভুয়া নাকি সঠিক, এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নারায়ণ দত্ত প্রদীপ এ ব্যাপারে বলেন, গত দুর্গাপূজার সময় প্রতিটি মণ্ডপে যুবকরা পাহারা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে এক টন, দুই টন করে চাল বরাদ্দ দিয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, আনসার, সেনাবাহিনী, র্যাব, স্বেচ্ছাসেবক থাকার পরও চালের বিনিময়ে পাহারার ব্যবস্থা কেন করা হবে–এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তালিকায় মন্দির ও সংগঠনের ভুয়া নাম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, পূজার পর চালের বরাদ্দের জন্য নতুন করে সংগঠনের নাম দিয়ে আবেদন করা হয়েছে। এ কারণে অনেককে চিনতে পারছেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন বলেছেন, ভুয়া তালিকার বিষয়টি নারায়ণ দত্ত প্রদীপ ভালোভাবেই জানেন।'
এদিকে জেলা শহরের রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সভাপতি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী জানান, পূজার সময় রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমকে শুধু ৫০০ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর পর আর কোনো বরাদ্দের কথা তাঁর জানা নেই। পূজার সময় কোনো সংগঠনকে পাহারার দায়িত্বও দেওয়া হয়নি। ৬৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামও নেই। শহরের বত্রিশ এলাকার গোপীনাথ জিউর আখড়ার সভাপতি মানিক রঞ্জন দে জানান, তাদের মন্দিরে পূজার আগে কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছিল। এর জন্য তখনই কিছু আলাদা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্দির পাহারার জন্য কোনো সংগঠনকে নিয়োগও দেওয়া হয়নি, কোনো বরাদ্দের খবরও তিনি জানেন না। তালিকায় এই মন্দিরের নামও নেই। তিনি এত বিপুল বরাদ্দের কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানকে একাধিকবার ফোন করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটি প্রশ্ন পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।'