বিশেষ প্রতিনিধি: স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সময়কালে ওয়াসা ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) হয়ে ওঠে দুর্নীতির আঁতুড়ঘর। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই দুটি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাসিক ভিত্তিতে ‘অঘোষিত চুক্তি’ করে দীর্ঘদিন ধরে তিনি ঘুষ গ্রহণ করে আসছিলেন। বিনিময়ে এসব সংস্থার কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন না।
ব্যক্তিগত খরচে ব্যবহার হতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান
এলজিইডি মূলত দেশের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সড়ক নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থাভাজন এই সংস্থা একসময় দক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রতীক ছিল। তবে তাজুল ইসলাম মন্ত্রী হওয়ার পর সংস্থাটি দুর্নীতির কুঠুরিতে পরিণত হয়।
প্রথমদিকে এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্পে হস্তক্ষেপ করলেও, পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে এক অঘোষিত আর্থিক সমঝোতায় পৌঁছান তাজুল। শর্ত ছিল—প্রয়োজনে যেকোনো সময় অর্থ দিতে হবে, বিনিময়ে এলজিইডির কার্যক্রমে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। এরপর থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যয়ের উৎস।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের জন্য এলজিইডির অন্তত ১২টি গাড়ি বরাদ্দ ছিল। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত বাবুর্চির জন্যও একটি পাজেরো গাড়ি ছিল, যা ব্যবহৃত হতো বাজার করা থেকে শুরু করে গ্রামের বাড়ি যাতায়াত পর্যন্ত। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে ছয়বার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান। প্রতিবারই যাবতীয় খরচ বহন করে এলজিইডি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবার সিঙ্গাপুর সফরের পরদিনই প্রধান প্রকৌশলীও সিঙ্গাপুরে যেতেন এবং হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতেন।
পদপ্রাপ্তিতে মোটা অঙ্কের ঘুষের অভিযোগ
এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগেও ছিল দুর্নীতির ছোঁয়া। সূত্র জানায়, সর্বশেষ প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আলী আক্তার হোসেনের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন তাজুল ইসলাম। এমনকি এলজিইডির হলরুম ব্যবহার হতো তাঁর আত্মীয়-স্বজনের পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও।
চট্টগ্রামে তাঁর স্ত্রীর নামে বাড়ি নির্মাণ, পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি উন্নয়ন ও রাস্তা নির্মাণের কাজ সরাসরি এলজিইডি বাস্তবায়ন করে। প্রকৌশলীরা সাইটে অবস্থান করে তদারকি করেছেন প্রতিটি নির্মাণকাজ।
ওয়াসার মাধ্যমে বিদেশে সম্পদ বিনিয়োগ
ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায়, মন্ত্রী হওয়ার পর তাজুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা একটি গোপন সমঝোতায় পৌঁছান। তাকসিম ওয়াসা থেকে ঘুষের অর্থ ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ও ফ্লোরিডায় তাজুল ইসলামের জন্য তিনটি বাড়ি কেনেন। পাশাপাশি, কানাডায় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের জন্যও বাড়ি কেনা হয়।
তাকসিম ছিলেন তাজুলের বিদেশে বিনিয়োগ তদারকির প্রধান সহায়ক। দুবাই, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে জমি ও সম্পদ কেনার কাজে তাকসিম প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ওয়াসার চেয়ারম্যান একবার তাকসিমের বিরুদ্ধে কথা বললে, তাজুল ইসলাম তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেন।
বিশ্লেষকদের মত
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে তাজুল ইসলামের স্থাবর সম্পত্তি ও ঘুষ-আয় অনুসন্ধান হলেও বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে তাঁর দুর্নীতির প্রকৃত মাত্রা এখনো অজানা রয়ে গেছে।
এলজিইডি ও ওয়াসার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত খরচ ও ঘুষের উৎসে পরিণত করার মাধ্যমে তাজুল ইসলাম ক্ষমতার অপব্যবহারের এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.