
নিজস্ব প্রতিবেদক: ৫ মার্চ ছিল লাগাতার হরতালের চতুর্থ দিন। ঢাকাসহ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল, স্বাধিকারকামী জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল, গণজমায়েত ও শপথের মধ্য দিয়ে বাংলার মুক্তি আন্দোলনের দিনটি অতিবাহিত হয়। বিভিন্ন স্থানে ক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানি পতাকা ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবিতে আগুন দেয়।
সকালে সেনাবাহিনীর গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় চারজন শ্রমিকের মৃত্যু হয় ও ২৫ জন আহত হন। এতে ঢাকাবাসী বিক্ষুবদ্ধ হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের উদ্যোগে ছাত্র-জনতা টঙ্গীর নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে ঢাকায় মিছিল বের করে। গুলিতে চট্টগ্রামে তিনজন নিহত হন। বিগত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও ১৪ জন আহত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। এই দিন পর্যন্ত চট্টগ্রামে আন্দোলনে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৮। গুলিতে খুলনায় দুজন এবং রাজশাহীতে একজন নিহত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানান, কেবল ঢাকা ও আশপাশেই সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ৩০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২০০ জন আহত হয়েছেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ থেকে ছাত্রছাত্রীরা লাটিসোঁটা নিয়ে মিছিল বের করে। ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র জমায়েত। পাকিস্তান লেখক সংঘ গণহত্যার প্রতিবাদে দেশজুড়ে মিছিল বের করে। বিকেলে কবি, সাহিত্যিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজপথে মিছিল করেন।
ঢাকা নগরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয় বিবৃতিতে সেনা কর্তৃপক্ষ বলে, শেখ মুজিব শান্তি বজায় রাখার আহ্বানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সন্ধ্যায় সরকরি ঘোষণায় বলা হয়, ঢাকায় সেনাবাহীনিকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১
জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে দিনটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আজ ছ’টা-দুটো হরতাল। জরুরি সার্ভিস হিসেবে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, আম্বুলেন্স, ডাক্তারের গাড়ি, সংবাদপত্র ও তাদের গাড়ি, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, দমকল, মেথর ও আবর্জনা ফেলা ট্রাক-এগুলোকে হরতাল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’২
বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ও বিবৃতি
রাতে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, বিদেশি বেতারে প্রচারিত জনাব ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিব ক্ষমতা ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে রাজি আছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, সেটি ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’। তিনি বাংলাদেশে নির্যাতন নির্যাতন বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানানোর কথাও অস্বীকার করেন। এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান করাচি থেকে এদিন ঢাকায় পৌঁছান। রাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ ভাসানী’) প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এদিন এক বিবৃতিতে ঐক্যবদ্ধ মুক্তিসংগ্রাম শুরু করার জন্য সব শ্রেণীর মানুষের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তাঁর দল মুক্তি সংগ্রামে নিয়োজিত যেকোনো ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।৩
গণহত্যা বন্ধে তাজউদ্দীনের আহ্বান
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এদিন একটি বিবৃতি দেন। তাতে তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুুলেটে নিরীহ-নিস্ত্র মানুষÑশ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধ করতে হবে। যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের জানা উচিত যে নির্বিচার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।৪
পিপিপির বক্তব্য
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে প্রায় পাঁচ ঘন্টা আলোচনা করেন। তাঁদের আলোচনা শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা বলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত অবাঞ্ছিত ও অযৌক্তিক। অধিবেশনস্থগিত রাখার জন্য পিপলস পার্টিকে দায়ী করা সংগত নয়।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সে জন্য পিপিপি দায়ী নয়। আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করতে পারবে কি না, তা নিয়ে পিপিপি সন্দিহান। এ জন্যই ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবী জানিয়েছিলেন।৫
লাহোরে আওয়ামী লীগ নেতারা আটক
এদিন বিকেলে লাহোরে আওয়ামী লীগের পাকিস্তান শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বি এ সলিমী ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরফরাজসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহত বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে করাচির বিভিন্ন মসজিদে গায়েবানা জানাজা আদায় ও ফাতেহা পাঠ করা হয়। লাহোরে এক সভায় সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।৬
সূত্র: ১. ইত্তেফাক ও সংবাদ, ৬ মার্চ ১৯৭১। ২. একাত্তরের দিনগুলি, জাহানারা ইমাম, সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা (২০০৫), পৃ.১৮। ৩. ইত্তেফাক ও দৈনিক পাকিস্তান, ৬ ও ৯ মার্চ ১৯৭১। ৪. পূর্বোক্ত। ৫. পূর্বোক্ত। ৬. পূর্বোক্ত।’