এনসিপিতে টানাপোড়েন

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি গতি পাচ্ছে না। যদিও দলটির বয়স মাত্র আড়াই মাস। এ সময়ের মধ্যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত দলের মতো তাদের রাজনৈতিক দূরদর্শী হওয়ার কথা নয়। তবুও দলটি নিয়ে অনেকেরই ছিল প্রত্যাশা।

দলটির যেভাবে আত্মপ্রকাশ এবং বর্তমান যে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন। নেতৃত্বের মধ্যে টানাপোড়েন ও সমন্বয়হীনতার কারণে রাজনীতিতে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। জনগণের সামনে এনসিপির বক্তব্য কী, তাও এতদিন স্পষ্ট ছিল না। তবে গত সোমবার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর দলটির প্রধান নাহিদ ইসলামের পক্ষ থেকে সাতটি বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরা হয়। সামনে আরো অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন নেতারা।

টানা সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটানো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের সমন্বয়ে গঠন করা হয় এনসিপি। বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতির মাঠে নামা দলটির ২১৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি মাসে বেশকিছু উইং, সেল ও একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আরো কিছু গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

এনসিপির নেতারা বলছেন, সব কমিটির প্রায় সব নেতার বয়সই ৩০ বছরের কাছাকাছি। ফলে দলটির ভেতরে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের সংঘাত। নানা মত ও পথ এবং বিভিন্ন মতাদর্শ থেকে আসা তরুণদের নিয়ে গঠিত মধ্যপন্থার সেই দল এনসিপিতে স্পষ্ট হচ্ছে আদর্শগত বিভাজনও। এ ছাড়া দলটিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও হচ্ছে বিলম্ব। শীর্ষ নেতাদের ছাড়া বড় বড় পদে আসীনদের সেভাবে ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত দলটি জেলা-উপজেলায় কমিটি দিতে না পারলেও তারা সবাই ঢাকার বড় নেতা। সাংগঠনিক কাজে ধীরগতি দেখা গেলেও সামাজিকমাধ্যমে তারা সরব। ফলে এনসিপির মধ্যকার টানাপোড়েন এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এনসিপির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে দলটি এগোচ্ছে। এনসিপিতে নির্বাচনি জোট গঠনের আলোচনাও রয়েছে। দলটির নেতৃত্বে সমমনা দলগুলো নিয়ে জোট গড়া হবে নাকি বড় দুই দলের কারো সঙ্গে জোট গঠন করবে, তা নিয়েও শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এতে নেতৃত্বের সংঘাতও ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে দলীয় একাধিক সূত্র।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এনসিপি নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয় নেই। তবে আরো ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে আমরা কিছুটা সময় নিচ্ছি। এটা নতুন একটি দল। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই পরস্পরের কাছাকাছি এসেছি। তাই আড়াই মাসের একটি দলের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর মতো আচরণ আশা করাও ঠিক হবে না। তারপরও এনসিপি যথেষ্ট বিচক্ষণতা (ম্যাচিউরিটি) ও সমন্বয় করেই কাজ করার চেষ্টা করছে। আমরা যে সমন্বয়হীনতার কথা বলছি, সেটা সময়ের সঙ্গে কেটে যাবে।

দৃশ্যমান সাংগঠনিক অগ্রগতি নেই

কোটা পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন গত বছরের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঐতিহাসিক ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ছাত্ররা। সংগঠনটি জেলা, মহানগর ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ’খানেক কমিটি গঠন করে। অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংগঠিত করতে গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত কয়েক মাসে দেশের অন্তত ৪৫০ থানায় প্রতিনিধি কমিটি গঠন করে সংগঠনটি। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে প্রায় সমানসংখ্যক নেতা যুক্ত হন দলটিতে। সংগঠন দুটির কার্যক্রম কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

সূত্রমতে, জেলা-উপজেলাসহ তৃণমূলের কমিটিগুলো এনসিপির কমিটিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হলেও গত আড়াই মাসে তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে এনসিপির মহানগর, জেলা ও উপজেলা কমিটি ১৫ মের দিকে দেওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের কারণে পিছিয়ে যায়। আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যে অনেক কমিটি ঘোষণা করা হবে। এজন্য কয়েকটি মহানগর, অনেক জেলা ও উপজেলার প্রস্তাবিত কমিটি প্রস্তুত রয়েছে।

এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা খুব দ্রুতই তৃণমূলে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে তৃণমূলে আমাদের প্রাথমিক কার্যক্রম আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির ব্যানারে। ফলে তৃণমূলে আমাদের একটি প্রাথমিক ভিত্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের জন্যও ঈদুল আজহার আগে বড় ধরনের একটি কমিটি প্রস্তুত করতে হবে। সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

দল সম্পর্কে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন আমার দেশকে বলেন, সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য আমরা গোটা দেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেছি। আমাদের সংগঠক ও সদস্যরা কাজ করছেন। তৃণমূলের সংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানা বাস্তবতার কারণে আমরা তৃণমূলে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে পারিনি। তবে আমরা আশাবাদী, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সংগঠক ও সদস্যরা সারা দেশে তৃণমূলের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে কমিটি ফরমেশনের দিকে অগ্রসর হবেন।’

এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, একটি রাজনৈতিক দলে বিভিন্নজনের বিভিন্ন কাজ অ্যাসাইন করা থাকে, তারা সে কাজগুলো করেন। এনসিপিতে চেইন অব কমান্ড রয়েছে, এটা কোনো ইস্যু নয়। তৃণমূলের কমিটি আমরা চলতি মাসের মধ্যে করে ফেলতে পারব। দলের নিবন্ধনের বিষয় আছে, এক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো চলতি মাসের মধ্যেই করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

বড় নেতা অনেক, কাজ কম

এনসিপির ২১৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি চারটি স্তরে বিন্যস্ত রয়েছে। এর মধ্যে দলটির আহবায়কের নেতৃত্বে দুজন সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও ১৬ জন যুগ্ম আহবায়ক রয়েছেন। এই স্তরের নেতারা দলের বহিঃরাজনীতি দেখভাল করেন। সদস্য সচিবের নেতৃত্বে দুজন সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ও ৩৩ জন রয়েছেন যুগ্ম সদস্য সচিব পদে। তারা দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দেখে থাকেন। উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠকের নেতৃত্বে ৯ জন যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও ১৮ জন সংগঠক রয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠকের নেতৃত্বে ৭ জন যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও ২৪ জন সংগঠক রয়েছেন। এই দুই স্তরের নেতাদের কাজ জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন এবং তৃণমূলের রাজনীতি দেখভালের। মুখ্য সমন্বয়কের নেতৃত্বে একজন সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও ২৪ জন যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক রয়েছেন। তাদের কাজ দলের বিভিন্ন উইং ও সেল গঠন এবং সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। এ ছাড়া ৫৯ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। এসব নেতার মধ্যে চার স্তরের শীর্ষ নেতাসহ হাতেগোনা কিছু নেতার বিভিন্ন কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানে সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে অপরিচিতদের রাজনৈতিকভাবে সেভাবে দেখা না গেলেও সামাজিকমাধ্যমে সরব থাকতে দেখা যাচ্ছে।

আদর্শগত বিভাজন: নানা মত-পথের তরুণের একদল

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা আগে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, গণ অধিবার পরিষদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, রাষ্ট্রচিন্তা, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, আম-জনতার দল, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন আদর্শিক ও রাজনৈতিক সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। জুলাই শহীদ পরিবার ও আহতসহ কোনো সংগঠন না করাও আছেন অনেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘু প্রতিনিধি, কওমি, আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়, সাবেক নেতা, কর্মকর্তা, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন এনসিপিতে। তাদের অনেকে বিভিন্ন আদর্শিক ও ঘটনার রাজনীতি এবং সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন আমার দেশকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এনসিপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সংঘবদ্ধভাবে দলের রাজনৈতিক অবস্থান ধারণ করে চলছেন। এখানে নানা মতাদর্শের (অনিয়েন্টেশন) মানুষ আছেন। কিন্তু তারা সবাই মধ্যম পন্থার রাজনীতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন। মতাদর্শিক জায়গায় এনসিপির বাইরে শুভাকাঙ্ক্ষী ও সমালোচকদের মধ্যে নানা ধরনের উৎকণ্ঠা, মতাদর্শিক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও দলগতভাবে মধ্যম পন্থার রাজনীতির ওপরই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, মধ্যম পন্থার রাজনীতি করার ঘোষণা দেওয়া এনসিপিতে ডানপন্থা, বামপন্থাসহ নানা পন্থা একাকার হয়েছে। এর মধ্যে মূলত ছাত্রশক্তি, বাম সংগঠনগুলো, গণ অধিকার পরিষদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্রশিবিরসহ ইসলামী সংগঠন থেকে আসা নেতাদের পৃথক বলয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্য সব সংগঠন থেকে আসা নেতাদের মধ্যে চিন্তা ও আদর্শগত খুব একটা ভিন্নতা না থাকায় মোটামুটি একদিকে ডানপন্থিরা এবং আরেক দিকে বাম নেতারা রয়েছেন। এ ছাড়া শীর্ষ চার স্তরের নেতাদের কেন্দ্র করেও একেকটা প্রভাববৃত্ত তৈরি হয়েছে। দলটির রাষ্ট্র সংস্কার এজেন্ডা, দলীয় গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, মেরুকরণের রাজনীতিতে দলের অবস্থান, দলীয় বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কর্মসূচি ঠিক করার ক্ষেত্রে বলয়গুলো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও এসব বলয়ের ছায়া পড়ছে।

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একাধিক ফেসবুক পোস্ট নিয়ে নানা বিতর্ক শুরু হয় রাজনৈতিক মহলে। এর মধ্যেই একাত্তর ও বাংলাদেশপন্থার প্রশ্নে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য জানিয়ে এনসিপির বিবৃতি আসে। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের শীর্ষ নেতাদের আরো আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে দেখা যায় ফেসবুকে।

গত শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে প্রগতিশীলদের মৈত্রীযাত্রায় এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক অনিক রায়সহ কয়েকজন নেতাকে অংশ নিতে দেখা যায়। সেখানে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই কর্মসূচি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে এনসিপির অনেক নেতার।

গত রোববার ফেসবুকে এক পোস্টে নারীদের অধিকার রক্ষায় যৌক্তিক দাবি সমর্থন করে সারজিস আলম বলেন, সেসবের আড়ালে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমকামিতা, ট্রান্সজেন্ডার কিংবা এলজিবিটিকিউর মতো জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক কালচারগুলো প্রমোট করা হলে সে অপচেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে হবে।

এর আগে গত মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে কিছু সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন নিয়ে দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ভিন্ন একটি পোস্ট দেন। ওই ইস্যুতে এনসিপির অনেক নেতাকে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিতে দেখা যায়, যা নিয়ে দলটির ভেতরে অস্বস্তি তৈরি হয়।

এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ আমার দেশকে বলেন, এনসিপিতে যে যার মতো করে মতপ্রকাশ করছেন। এই স্বাধীনতা রয়েছে। সেই সঙ্গে দলে জবাবদিহিও রয়েছে। দলটি যেহেতু নতুন, সে জায়গা থেকে মনে হতে পারে যে যার মতো করে মতামত প্রকাশ করছেন, ব্যক্তি আকারে মতামতগুলো আসছে। তবে ক্রমশ এগুলো সাংগঠনিকভাবে প্রকাশ পাবে। এখানে নেতৃত্বের কোনো সমস্যা নেই।

সাত বিষয়ে এনসিপির বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি

সবশেষ এনসিপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সোমবার দলীয় ফেসবুক পেজে দলটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের ‘কয়েকটি বিষয়ে এনসিপির দৃষ্টিভঙ্গি’ শিরোনামে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। এতে সাতটি বিষয়ে এনসিপির অবস্থান স্পষ্ট করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের আকাঙ্ক্ষা ধারণ ও বাস্তবায়ন, সেক্যুলারিজম বা ধর্মতন্ত্রÑ কোনো মতবাদকেই তাদের দলীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচনা না করা; ধর্মীয় সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও দায়-দরদ চর্চার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়া; ইসলামবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা; ধর্মীয় উগ্রতা বা চরমপন্থাকে সমর্থন না করা; জাতি, ধর্ম বা গোত্রভিত্তিক পরিচয়ের পরিবর্তে সভ্যতাগত জাতীয় পরিচয় ধারণ; হিন্দু-মুসলমান-দলিতের সংগ্রামের ভিত্তি, নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের মূলনীতি, ভারতীয় আধিপত্যবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, ন্যায্যতা ও জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি, বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ভিশন, বৈষম্যহীন ইনসাফভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, এনসিপির নেতাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য অনেক পর্যায়ে কাজ করছি। যাতে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা এবং অন্য নেতাদের সঙ্গে দলীয় ফোরামে একত্রে কাজ করতে পারি, সে ধরনের ব্যবস্থাপনা আমরা শুরু করেছি। মোটা দাগে সমন্বয়হীনতার মতো বিষয় ঘটছে বলে আমাদের মনে হয়নি।

নানা আদর্শের সম্পর্ককে ইতিবাচক দেখা

তবে এনসিপির কয়েকজন নেতার ভাষ্য, বিভিন্ন সংগঠন এবং নানা ঘরানার রাজনীতি করলেও তারা সবাই এখন এনসিপির রাজনীতি করছেন। এনসিপির নেতারা বিভিন্ন ধরনের, অঙ্গনের ও মতাদর্শের মানুষের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক গড়তে পারছেন। এতে তাদের চিন্তা-ভাবনায় আদর্শগত মিথস্ক্রিয়াও ঘটেছে। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা উচিত। স্বাধীনতার এত বছরেও এই জাতি বিভক্তই থেকে গেছে। এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। সে কাজটিই এনসিপি করার চেষ্টা করছে।

অন্য কয়েকজন নেতার মত, গণ অধিকার পরিষদে ছাত্রশিবিরের অনেকে যুক্ত হয়েছেন। ছাত্রশক্তিতে যুক্ত হওয়াদের মধ্যেও অনেকে আগে শিবির করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়া বামদের মধ্যেও ভিন্ন চিন্তা রয়েছে। কওমি অঙ্গন থেকে যারা নাগরিক কমিটি ও পরে এনসিপিতে এসেছেন, তাদেরও অন্য মত থাকাটা স্বাভাবিক। তবে তারা সবাই জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি, এ জনপদের জনগোষ্ঠী। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন করতে হলে বহু মত ও পথের এক বিন্দুতে মিলন ঘটাতে হবে। সেটি করারই চেষ্টা করছে এনসিপি।

গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার : কোরআন কী বলে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে কোরআন পাঠ আন্দোলন। এতে চিন্তক ফরহাদ মজহার এনসিপির তরুণ নেতাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিরোধ দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এক সময় সেক্যুলার বনাম ইসলামপন্থি বিরোধ দেখা গেলেও এখন ইসলামপন্থিদের মধ্যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে। ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন বিরোধ দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এনসিপির তরুণদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এটি ক্ষতিকর। এজন্য গণঅভ্যুত্থানের মর্ম বুঝতে হবে, তা হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করা আর গণসার্বভৌমত্ব মানে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।

ফরহাদ মজহারের মতে, এনসিপির মধ্যে এ বিরোধের বড় কারণ হলো গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণ বিজয়ে নিয়ে যেতে না পারা। তার আগেই ছাত্র-তরুণদের বিরাট আত্মত্যাগকে নস্যাৎ করার জন্য একটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব হয়েছে। ছাত্রদের দমন করার জন্য বিভিন্নভাবে ক্রমাগত অপপ্রচারের বেড়া দিয়ে তাদের চেষ্টাকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া চলছে।

যেভাবে এনসিপির উত্থান

সূত্রমতে, এনসিপির আজকের এই তরুণদের দল গড়ে ওঠার পেছনে অনেক প্রেক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে ভিপি নুরুল হক নুর ও সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেনসহ কয়েকজন নির্বাচিত হন। তখন রাষ্ট্রচিন্তায় যুক্ত হন অনেকে। রাজনৈতিক গ্রুমিং হয় সেখানে। ২০২১ সালে গণ অধিকার পরিষদ গঠন করে রাজনীতিতে সক্রিয় হন নুর। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন সামনে আসে। ২০২৩ সালে আখতারের নেতৃত্বে অধিকার পরিষদ থেকে ছাত্রদের নিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি গঠিত হয়। গণ অধিকার পরিষদ ভেঙে তিন ভাগ হয়। দুই ভাগ একত্র হলেও আম-জনতার দল গঠিত হয় তারেক রহমানের নেতৃত্বে। ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আবার কোটা আন্দোলন সংগঠিত হয়। এতে যুক্ত হয় ছাত্রশক্তি, ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনের সামনে ছিলেন ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব নাহিদ ইসলামসহ অন্যরা। এক্ষেত্রে ছাত্রশক্তির বাইরে থেকে এসে লাইমলাইটে চলে আসেন সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আলী আহসান জুনায়েদ, সাদিক কায়েমসহ বেশ কয়েকজন। ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে প্রথমে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হয়। এতে ছাত্রশক্তি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেকে যুক্ত হন। এর মধ্যে ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাকর্মীরাও ছিলেন। ছাত্রশিবিরের তখনকার নেতারা এ সংগঠনে যুক্ত হননি। ছাত্রশক্তিসহ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) গঠন করেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) অনেকে যুক্ত হলেও মতপার্থক্যের জেরে আলী আহসান জুনায়েদসহ শিবিরের সাবেক নেতাকর্মীরা বেরিয়ে যান। তারাসহ অভ্যুত্থানের পক্ষের অন্যরা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)’ গঠন করেন। এ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের ৮০টির বেশি সংগঠন মিলে জুলাই ঐক্য গঠন করেছে। জুলাই মঞ্চ নামে আরেকটি প্ল্যাটফর্মও রয়েছে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নেতৃত্বের সংকটে কার্যত বিলুপ্তপ্রায়। সংগঠন দুটির কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম একাধিক সংগঠক বলছেন, এখানে একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে লক্ষ করা যায়। তা হলো আদর্শগত ও মতবিরোধের জেরে একেকটি সংগঠন যেমন ভেঙে নতুন সংগঠনের জন্ম হয়েছে, তেমনই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোও বিভাজিত হয়ে পড়েছে।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

শার্শায় সাংবাদিকতার আড়ালে মাদক ব্যবসা, বিজিবির হাতে আটক ছাত্রলীগ নেতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোরের শার্শায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও দৈনিক নাগরিক ভাবনা পত্রিকার শার্শা উপজেলা প্রতিনিধি শেখ মফিজুর রহমানকে (২৯) ১০০ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করেছে বিজিবি।

গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যা মামলার আসামি ক্রিকেটার সাকিব

নিজস্ব প্রতিবেদক: আদাবরের রিংরোডে গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য ও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে। ডিএমপির আদাবর থানায়

মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী’

বাংলা পোর্টাল: দুই দিনের সফরে নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (১৩ জানুয়ারি’) সকালে সেখানে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান তিনি। পরে

দ্বিতীয় ধাপে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে: সিইসি

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)

স্বাধীনতা দিবসে বীর শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা’

নিজস্ব প্রতিবেদক: মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সাভার স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের ফুল দিয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার (২৬ মার্চ’)

মারধরের পর শ্বশুরবাড়ি ফিরলেন সেই মিম

নিজস্ব প্রতিবেদক: পটুয়াখালীর বাউফলে ঈদের দিন রাস্তায় প্রকাশ্যে এক তরুণীকে মারধরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ঘটনার পর পুলিশ ও চেয়ারম্যানের সমঝোতায়