এনবিআর কর্মকর্তার ঘুষ বাণিজ্যে রাজস্ব ক্ষতি ১৬০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের আশীর্বাদে ছোটপদে থেকেও পেয়েছিলেন বড়পদের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। ফলে, যাচ্ছেতাই করে বেড়িয়েছেন এনবিআরের তৎকালীন দ্বিতীয় সচিব নিয়াজ মোর্শেদ। ক্ষমতাকে পরিণত করেছিলেন টাকা কামানোর মেশিনে। অনৈতিক কাজ পাইয়ে দেওয়া, বদলিতে হস্তক্ষেপ, সরাসরি ঘুষের লেনদেনসহ সব ধরনের অপকর্মের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন তিনি।

অধিক্ষেত্রের তোয়াক্কা না করে ১০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারের ১৬০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি করেছেন নিয়াজ। পরে এ নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও তা আটকে যায় নিয়াজের অদৃশ্য ক্ষমতায়। এছাড়া ফ্যাসিস্টের দোসর হয়েও তিনি বর্তমানে বাগিয়ে নিয়েছেন ব্রাসেলসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলরের লোভনীয় পদ। এ নিয়ে আয়কর বিভাগের সৎ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে তীব্র অসন্তোষ। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিএসআরএম লিমিটেড ও বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের ১০ জন বিদেশি বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রির বিপরীতে উৎসে কর দেননি। যদিও তৎকালীন আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ধারা ৫৬(১) অনুযায়ী উৎসে কর কেটে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। এনবিআরের কর অব্যাহতির সনদ ছাড়া এই কর এড়িয়ে যাওয়া আইনি সুযোগ নেই। করদাতাদের ব্যাংক হিসাব ছিল হাবিব ব্যাংকে। তবে হাবিব ব্যাংক কর কেটে না রাখায় তা নিয়ে আপত্তি তোলে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে এনবিআরকে ২০২০ সালের জুলাইয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এনবিআরের করনীতি শাখা থেকে একই বছরের আগস্টে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এনবিআরের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া কোনো করদাতা মূলধনী লাভের ওপর করমুক্ত বা কমহারে কর দেওয়ার সুবিধা পাবেন না। একইসঙ্গে স্টক ডিভিডেন্ড বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মূলধনী লাভের জন্য নির্দিষ্টহারে কর দিতে হবে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে উৎসে কর না কাটলে প্রতিমাসে ২ শতাংশ হারে জরিমানা কার্যকর হবে।

এনবিআরের স্পষ্টীকরণ পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হাবিব ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু বিএসআরএমের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরকে ম্যানেজ করে দীর্ঘ দুই বছর বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখে। পরে সুবিধাজনক ব্যাখ্যার বদলে বিএসআরএমের কর উপদেষ্টা ও অবসরপ্রাপ্ত কর কমিশনার হুমায়রা সাইদার কাছ থেকে ১০ কোটি টাকার মোটা অংকের উৎকোচের চুক্তি করেছিলেন নিয়াজ। তাই ব্যাখ্যা পরিবর্তন করতে তিনি করনীতি শাখার দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তখন ক্ষমতার অপব্যবহারে লিপ্ত হন তৎকালীন আর্ন্তজাতিক চুক্তি ও মতামত শাখার দ্বিতীয় সচিব নিয়াজ মোর্শেদ।

দুই বছর ধামাচাপার পর দাপ্তরিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ অধিক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে ২০২২ সালের অক্টোবরে বৃহৎ করদাতা ইউনিটকে (এলটিইউ) আইনের বিষয়ে মতামত দেন নিয়াজ। তখন সে সময়ের এলটিইউ কমিশনার মো. ইকবাল হোসেন অবৈধ মতামতটি বাংলাদেশ ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক ও বিএসআরএমের কর উপদেষ্টা হুমায়রা সাইদকে এনবিআরের মতামত হিসেবে পাঠিয়ে দেন।

যদিও এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ কর সংক্রান্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন, প্রজ্ঞাপন ও এসআরও প্রণয়ন, অর্থ বিল প্রণয়নে সহায়তা প্রদান, আয়কর আইনের ব্যাখ্যা স্পষ্টীকরণ প্রদানের দায়িত্ব করনীতি শাখার। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কর শাখার অধিক্ষেত্র ছিল দ্বৈত করারোপ চুক্তি সম্পাদন, প্রটোকল স্বাক্ষর, আন্তর্জাতিক চুক্তির ওপর মতামত, ট্রান্সফার প্রাইসিং ও মানিলন্ডারিং।

১৬০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি : এখতিয়ার না থাকলেও আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়াজ। তিনি ব্যাখ্যায় বলেন, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৫৬ অনুযায়ী করদাতাদের মূলধনী লাভের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না। সেইসঙ্গে এনবিআর থেকে সনদ না নেওয়ার কারণে প্রাপ্য কর অব্যাহতি সুবিধাও পেতে পারেন। এই বেআইনি মতামতের ফলে সরকার হারিয়েছে ১৫৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা কর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, করহার কত হবে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার আন্তর্র্জাতিক কর শাখার নেই। এই দায়িত্ব এনবিআরের করনীতি শাখার।

কেউ যদি ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের অধিক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে কাজ করেন, সে বিষয়ে এনবিআর ব্যবস্থা নেবে।

যোগসাজশে প্রভাবশালী কর্মকর্তারা : নিয়াজের সঙ্গে এই যোগসাজশে যুক্ত ছিলেন আয়কর বিভাগের আরও দুই কর্মকর্তা। তাদের একজন তৎকালীন আন্তর্জাতিক কর শাখার সদস্য একেএম বদিউল আলম। বিসিএস ১৩তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট শাখার সদস্য। এছাড়া যুক্ত ছিলেন বিসিএস ১৩তম ব্যাচের তৎকালীন এলটিইউ কমিশনার মো. ইকবাল হোসেন। তিনি বর্তমানে চাকরি শেষ করে পিআরএলে আছেন। আর শত অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত নিয়াজ এখনো ক্ষমতার দম্ভেই আছেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি হয়েছেন যুগ্ম কর কমিশনার। এছাড়া চার বছরের জন্য তিনি হয়েছেন ব্রাসেলসের কমার্র্র্র্শিয়াল কাউন্সেলর। এই কর্মকর্তাদের ১০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া বিএসআরএমের কর উপদেষ্টা হুমায়রা সাইদা নিজেও বিসিএস নবম ব্যাচে কর কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

নিয়াজকা-ের তদন্ত শুরু : ঘুষের বিনিময়ে নিয়াজের এই অবৈধ কাজের অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। জানা গেছে, পরে এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে এই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক করের দায়িত্বরত সদস্য মো. লুৎফুল আজীমকে। তবে আগে থেকে নিয়াজের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় এ তদন্ত নিয়ে সন্দিহান খোদ আয়কর কর্মকর্তারাই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লুৎফুল আজীম এই তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন।,

আয়কর কর্মকর্তাদের অসন্তোষ : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা তিনবার দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের আস্থাভাজন ছিলেন নিয়াজ। সেই সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন।

সব সময় ভালো বদলি, ঘনঘন বিদেশ সফর, ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মকর্তাদের ওপর খবরদারি, বদলি বাণিজ্য, বিভিন্ন কর অঞ্চলে বিভিন্ন করদাতার ফাইল নিয়ে তদবির বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন নিয়াজ।

তবে বর্তমান সময়েও নিয়াজের এই প্রভাব দেখে অসন্তোষ রয়েছে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে। তারা বলেছেন, সবসময় ভালো বদলি পেয়ে ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন তিনি। নানা অনিয়মের পরও এখন আবার ব্রাসেলসের কর্মাশিয়াল কাউন্সেলর করা হলো তাকে। এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা আরও প্রশ্রয় পাবেন। অন্যদিকে সৎ কর্মকর্তারা বঞ্চিতই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, ‘এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার বা নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি। বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রত্যয়ন দেয় আন্তর্জাতিক কর শাখা। করনীতি বিভাগ আন্তর্জাতিক কর অধিক্ষেত্র বিষয়ে কোনো মতামত দেয় না। এলটিইউর কমিশনার আন্তর্জাতিক কর শাখার মেম্বারের কাছে করারোপ, জরিমানা এবং হাবীব ব্যাংকের কোনো দায় আছে কিনা, সে বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। তখন আমরা সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছি এবং নিয়মানুসারে যথাযথ কর আরোপ করা হয়েছিল। তাছাড়া আমি ছিলাম তখন জুনিয়র অফিসার, এটা আমার মাধ্যমে কিভাবে হবে? প্রয়োজনে আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

ইটনা হাওর থেকে কোটি টাকার মাছ লুটের অভিযোগ

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: কিশোরগঞ্জের ইটনা হাওরে জলমহাল থেকে দুর্বৃত্তরা প্রায় কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (৪ মার্চ) দুপুরে ইটনা উপজেলার ধনপুর

হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা, কে এই বিচারক গোলাম মর্তুজা

নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি

অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবিকে তথ্য দেয়ার অনুরোধ

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ রোধে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সোমবার বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ

শিবিরকে ফাঁসাতে ছাত্রদল কর্মীর কাণ্ড, ক্ষমা প্রার্থনা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্রশিবিরের ইমেজ সংকট তৈরি ও ফাঁসাতে আক্রমণ করার ‘নাটক সাজিয়ে’ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আবাসিক হলে হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে

সংসদ নির্বাচন হতে পারে ১২ ফেব্রুয়ারি গাজী শাহনেওয়াজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত মঙ্গলবার এ রোডম্যাপ অনুমোদন দেয় কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ইসির

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে কড়া নিরাপত্তা, বসানো হয়েছে চেকপোস্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডাকসু নির্বাচন ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫ ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে নেওয়া হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ভোটগ্রহণ