
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: গোপালপুরের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান মো. হৃদয় (২০)। নিজের লেখাপড়ার খরচ ও পরিবারের হাল ধরতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে যান তিনি। শুরু করেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো। কিন্তু অল্প সময়েই থেমে যায় তার স্বপ্নযাত্রা। পরিবারের দাবি, সরকার পতনের পর বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান হৃদয়। এক বছর পেরিয়ে গেলেও মেলেনি তার মরদেহ।
গত বছর ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেন হৃদয়। ওইদিন পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলি চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের গুলিতে হৃদয় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং পুলিশ সদস্যরা তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি গলির ভেতর নিয়ে যান।
পরিবার অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার পর পুলিশ হৃদয়ের মরদেহ গুম করে। ভাইয়ের মরদেহ না পাওয়ায় বিচার তো দূরের কথা, একটি কবরস্থান দেখার আশাও অধরাই থেকে গেছে পরিবারটির কাছে। এখনো তারা জানেন না হৃদয়ের কবর কোথায়, কীভাবে তাকে দাফন করা হয়েছে।
হৃদয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামে। বাবা লাল মিয়া একজন দিনমজুর, মা রেহেনা বেগম গৃহিণী। হৃদয় হেমনগর ডিগ্রি কলেজের (প্রথম বর্ষ) শিক্ষার্থী ছিলেন।
ঘটনার দিন হৃদয়ের সঙ্গে ছিলেন তার বোন জামাই ইব্রাহিম হোসেন। তিনি জানান, আমরা গাজীপুরে একসাথে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। ওইদিন বিজয় মিছিলে গিয়েছিলাম দু’জনেই। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে হৃদয় নিহত হয়। আমি ভয়ে এগোতে পারিনি। রাতেই তার মরদেহ গুম হয়ে যায়।
প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিও ফুটেজেও দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা হৃদয়কে সড়কে লাঠিচার্জ ও মারধর করেন। পরবর্তীতে এক পুলিশ সদস্য তার দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালান। রক্তাক্ত হৃদয়কে পরে গলির ভেতর নিয়ে যেতে দেখা যায়।
হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই। আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি। কিস্তিতে কেনা গাড়ির টাকাও এখনো শোধ হয়নি। আমার ছেলে বেঁচে থাকলে সংসারের সব দায়িত্ব নিতে পারতো।
বোন জেয়াসমিন আক্তার বলেন, হৃদয়ের আশা ছিল পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে। কিন্তু এখন আমরা মরদেহই খুঁজে পাচ্ছি না। প্রশাসন মামলা নিয়েছে, কিন্তু তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।
বাবা লাল মিয়া বলেন, আমি কিছু চাই না, শুধু আমার ছেলের হাড়গোড় ফেরত দিক, জানি কোথায় কবর দিতে পারি। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের স্বীকৃতি চাই।
এ বিষয়ে গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তুহিন হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। মামলার অংশ হিসেবে গত ২৪ জুলাই গাজীপুরের তুরাগ নদীতে হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধারে অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশ সদস্যরাও। কিন্তু তাতেও খোঁজ মেলেনি হৃদয়ের।
এ মামলায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা এবং সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে হুকুমের আসামি করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও আড়াই থেকে তিনশ’ জনকেও আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।