নিজস্ব প্রতিবেদক: কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া সীমান্ত দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে চোরাচালান। উল্লেখযোগ্য হারে আসছে মিয়ানমারের গরু, মাদক ও চোরাই পণ্য। দেশ থেকে যাচ্ছে নিত্যপণ্য এবং জ্বালানি তেল। এসব চোরাচালান চক্রের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ দিচ্ছে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ি। স্থানীয়দের কাছে পুলিশের ‘অঘোষিত ক্যাশিয়ার’ নামে পরিচিত মো. ফোরহান ওরফে সোহেল (২৮) চোরাকারবারিদের কাছ থেকে দিনে দুই লাখের বেশি টাকা চাঁদা আদায় করছেন। এসব টাকা গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শোভন কুমার সাহা ভাগ-বাঁটোয়ারা করছেন; যা থেকে দিনে লাখ টাকার বেশি আয় হচ্ছে তার।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা ও একজন জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, গর্জনিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে ভোজ্যতেল, চাল-ডাল, পেঁয়াজ-রসুন, সিমেন্ট ও বিভিন্ন নিত্যপণ্য। ওপার থেকে আসছে ইয়াবা, আইসসহ মিয়ানমারের গরু। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যাওয়া বিভিন্ন পণ্যের বস্তা প্রতি ৫০০ টাকা ও মিয়ানমার থেকে আসা প্রত্যেক গরু থেকে দুই হাজার টাকা; ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি চাঁদা নিচ্ছে পুলিশ। বিশেষ করে গরুর বহরে লুকিয়ে আনা হয় ইয়াবা ও আইসের চালান। মিয়ানমারের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী কম দামে গরুর সঙ্গে ইয়াবা ও আইসের চালান পাঠিয়ে বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানি নেয়।
প্রতিদিন প্রকাশ্যে অবৈধ পণ্য পরিবহন হলেও গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির কোনও তৎপরতা নেই। উল্টো নিয়মিত চাঁদা নেওয়ার মাধ্যমে চোরাকারবারিদের নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছেন গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শোভন কুমার সাহা। ফাঁড়ির সদস্যদের মদতে গর্জনিয়া বাজার ও আশপাশের সড়কে অবৈধভাবে চলা প্রতি মোটরসাইকেল থেকে এক হাজার, টমটম থেকে দুই হাজার, আর জিপ বা পিকআপ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আনা প্রতিটি গরুর জন্য গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের নামে দুই হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। কোনও কোনও দিন ১০০ গরু এলে চাঁদার টাকার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।
গরু-মাদক পাচারের ট্রানজিট গর্জনিয়া হাট
স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দুই ইউনিয়ন রামু উপজেলার গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া। দুই ইউনিয়নের প্রধান বাজার গর্জনিয়া। সপ্তাহে দুই দিন বসে হাট। বাজারটি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায়। গত বছর এটির ইজারা হয়েছিল প্রায় আড়াই কোটি টাকায়। এবার ইজারা হয়েছে ১০ গুণ বেশি প্রায় ২৫ কোটি টাকায়। গত ৮ মার্চ বাজারটি ইজারা নিয়েছেন রামু উপজেলা যুবদলের সদস্যসচিব তৌহিদুল ইসলাম। তার নেতৃত্বে বিএনপি সমর্থক ৪০ জনের বেশি নেতাকর্মী-ব্যবসায়ী বাজারটি আগামী এক বছর নিয়ন্ত্রণ করবেন। আগে নিজের দলীয় লোকজন দিয়ে বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করতেন কক্সবাজার-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল।
এবার শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল, ইউনিয়ন পর্যায়ের এই বাজার কেন এত চড়া মূল্যে ইজারা হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী এই বাজার চোরাই গরু বিক্রির হাট ও মাদক চোরাচালানের ‘ট্রানজিট’ হিসেবে পরিচিত। হাটটি ঘিরে বেড়েছে সীমান্তে চোরাচালান। আসছে গরু ও মাদক। সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্য এবং জ্বালানি তেল। গরু ও মাদক চোলাচালানের কথা স্বীকারও করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
চোরাচালান চক্রের একাধিক সদস্য ও গর্জনিয়ার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রামুর শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত গর্জনিয়া। সীমান্তের এই পথ দিয়ে মিয়ানমার থেকে গরু, সুপারি এবং ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্য আসছে প্রতিদিন। বিপরীতে মিয়ানমারে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও জ্বালানি তেল। চোরাচালান রোধে ২০০৫ সালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাট দিয়ে মিয়ানমারের গবাদিপশুর করিডর চালু করা হয়েছিল। রাজস্ব দিয়ে এই করিডরের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা গরু-মহিষ আনতেন। তবে ২০২২ সালে দেশীয় খামারিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করিডর বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম ও কক্সবাজারের উখিয়ার সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান শুরু হয়। চোরাই পথে আসা গরুর বৈধতা দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে গর্জনিয়া বাজার। রামু সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর পার হয়ে এই বাজারে যেতে হয়। কয়েকদিন আগে বাজারটিতে গিয়ে দেখা গেছে, শতাধিক ছোট-বড় ট্রাকে গরু বোঝাই করা হচ্ছে। এগুলো যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
পুলিশ, স্থানীয় লোকজন ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পথ দিয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন হাজারো গরু ঢুকছে দেশে। তার বেশিরভাগ গরু গর্জনিয়া বাজারে তোলা হয়। তবে কিছু গরু পাহাড়ি পথ বেয়ে অন্যান্য বাজারে নেওয়া হয়। চোরাই পথে আসা এসব গরু স্থানীয় হিসেবে চালাতে চোরাকারবারিরা ইউনিয়ন পরিষদের কাগজপত্রও ব্যবহার করছে। ২০২৪ সালে তিন লাখের বেশি গরু মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এসব গরু গর্জনিয়া বাজার ঘুরে কক্সবাজার, ঈদগাঁও, চকরিয়া হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছে।
পুলিশের ‘অঘোষিত ক্যাশিয়ার’ সোহেল
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা ও দুজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গরু ও ইয়াবার চালান লুটের ঘটনা নিয়ে গর্জনিয়ার শাহীন ডাকাত বাহিনীর সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পাঁচ জনের মৃত্যু ঘটে। বিজিবির সঙ্গেও কারবারিদের গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ বেলালের ছেলে মো. ফোরহান ওরফে সোহেল দুই বছর আগে সীমান্তের আলোচিত গরু চোরাচালান চক্রের গডফাদার শাহীন ডাকাতের হাত ধরে সীমান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। পরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে শাহীন ডাকাত গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে তার হাল ধরেন সোহেল। একইসঙ্গে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শোভন সাহার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর শোভন আর সোহেল মিলে গড়ে তোলেন চোরাচালান চক্রের যাতায়াতের শক্তিশালী সিন্ডিকেট।,
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সম্প্রতি মিয়ানমারে পাচারের সময় ইউরিয়া সার, জ্বালানি তেল, পেঁয়াজ-রসুন, আদার প্রতি বস্তা থেকে ৫০০ টাকা আর ওপার থেকে আসা প্রতি গরু থেকে দুই হাজার টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন সোহেল। তাকে এলাকার সবাই পুলিশের ‘অঘোষিত ক্যাশিয়ার’ হিসেবেই চেনেন। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। এসব টাকা যাচ্ছে শোভন সাহার কাছে।
অবশ্য বিষয়টি স্বীকারও করেছেন সোহেল। তবে বর্তমানে এসব কাজ করছেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বাংলা বলেন, ‘আগে পুলিশের হয়ে এসব কাজ করতাম। এখন করি না। ওই সময় কিছু টাকা উঠিয়ে পুলিশকে দিতাম। কয়েক মাস আগে গর্জনিয়া ছেড়ে চকরিয়ায় আসছি।’ কেন গেছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি কোনও অপরাধ করিনি। তবু রামু থানা পুলিশ আমাকে খুঁজছে। কেন খুঁজছে, তা জানি না।’
অভিযোগ অস্বীকার করে ইনচার্জের
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শোভন কুমার সাহা বাংলা বলেন, ‘আমি সোহেলকে চিনি না। আমার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ সত্য নয়।’
এ বিষয়ে রামু থানার ওসি মো. আরিফ হোসাইন বাংলা বলেন, ‘পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। এ কারণে সোহেলকে খুঁজছি আমরা। আমার থানার কোনও পুলিশ যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন পুলিশ সুপার
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এএনএম সাজেদুর রহমান বাংলা বলেন, ‘গত ৩০ নভেম্বর আমি এখানে যোগ দিয়েছি। পুলিশ ফাঁড়ি তো দূরের কথা এখনও কোথায় কোন থানা তা আমি জানি না। সব থানার ওসির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে উঠেনি। তারপরও যদি গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ অপরাধ করে কারও পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.