নিজস্ব প্রতিবেদক: ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরুর ৩৯ দিনের মাথায় ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু ডলারের তীব্র সংকট, ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট এবং অর্থ পাচারের কারণে নানামুখী সংকটে তখন দেশের অর্থনীতি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরুর ৩৯ দিনের মাথায় ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু ডলারের তীব্র সংকট, ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট এবং অর্থ পাচারের কারণে নানামুখী সংকটে তখন দেশের অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রীতিমতো পিষ্ট সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে অনুরোধ করা হয়, যা অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই জানান। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েও তিনি দেশ পুনর্গঠন ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে সহায়তা করতে দাতা সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেলেও সে আহ্বানে এখন পর্যন্ত সাড়া মেলেনি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের নয় মাস (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি মিলেছে ৩০০ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের মতো, যা গত অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ৫৮ শতাংশ কম। অথচ আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময় প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ডলারের।
দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ ও আর্থিক খাত সংস্কারে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বড় আকারে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। এছাড়া পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক সহায়তার বাইরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আরো ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চায় ড. ইউনূসের সরকার। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয় আইএমএফের কাছে। আর এক বিলিয়ন করে ২ বিলিয়ন ডলার দিতে বিশ্বব্যাংক ও জাইকাকে অনুরোধ জানানো হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত সেপ্টেম্বরে প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেও তিনি বেশ কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। নিউইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের অংশীদারত্বও চান। এরপর চীন, থাইল্যান্ড, কাতারসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। সেই সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। যদিও এখন পর্যন্ত তার সুফল মেলেনি। উল্টো বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি প্রতিনিয়তই কমছে।
অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাতা সংস্থাগুলো মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ ও অনুদান হিসেবে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ওই অর্থে আসেনি। সে কারণেই বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি কম। তবে অন্তর্বর্তী সরকার বৃহৎ দুই-একটি প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে। তাতে বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সহায়তাকারী দেশগুলো পরিকল্পিত বিনিয়োগের দিকে যেতে পারে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি আসে মূলত দুইভাবে। প্রথমত, বাজেট সহায়তা এবং দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের ঋণ সহায়তা হিসেবে। ঋণ সহায়তা পাওয়া যায় মূলত নতুন কোনো প্রকল্প নেয়া হলে। এ সরকার নতুন কোনো প্রকল্প নিচ্ছে না। যে কারণে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা কম।’
সরকারের বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে নতুন ঋণ আসবে বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে বাজেট রাখা হতে পারে। সেখানে ৪৫ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা রয়েছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থ ছাড় হলে সেখানে কিন্তু বৈদেশিক ঋণ সহায়তার বড় অংশ যুক্ত হবে।’
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাঁচটি দেশ ও দাতা সংস্থা। এর মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে ৭০ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৯৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ১৬ কোটি ডলার, জাপান ৮৩ কোটি ৪১ লাখ ডলার এবং অন্যান্য দেশ ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে ৩৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
এদিকে বিদেশী দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ সহায়তা কমার পাশাপাশি অর্থ ছাড়ও আগের চেয়ে কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই থেকে মার্চ) দাতা সংস্থাগুলো অর্থ ছাড় করেছে ৪৮০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। চলতি অর্থ ছাড়ের মধ্যে প্রকল্পের ঋণ হিসেবে পাওয়া গেছে ৪৪৭ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। আর অনুদান হিসেবে ৩৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার পাওয়া গেছে।
বিদেশী ঋণ সহায়তা কমে যাওয়ার পেছনে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প না থাকা অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ কিংবা ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে দাতা সংস্থাগুলো নানা ধরনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকে। আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে দরকষাকষিতে মতপার্থক্য ও দূরত্ব তৈরিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সরকারের প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, তা অব্যাহত থাকলে ঋণ সহায়তা আরো কম আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈদেশিক ঋণ সহায়তা কমে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, অনেকগুলো প্রকল্পের গতি শ্লথ হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। এছাড়া আমলাতান্ত্রিক একটা জটিলতা তো চলছেই। যে কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়তো কাজ করছে। বিগত সরকারের সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে অনেকগুলোয় দুর্নীতি হয়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নেগোসিয়েশন কিংবা হোমওয়ার্ক ঠিকমতো না হলে অর্থ ছাড় হবে না। অর্থ ছাড় না হওয়ার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় কারণ হতে পারে। কারণ উন্নয়ন সহযোগীরা প্রকল্পে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক।’
তিনি মনে করেন, ‘এ সরকার আসার পর অনেক সময় ছিল, যেখানে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করারও সুযোগ ছিল। তাদের কাছ থেকে সরকার কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারত।’
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিও গত নয় মাসে ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থবছরের আট মাস বিবেচনায় এটি ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে মোট প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৩৫৩টি। বিপরীতে বরাদ্দ ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অথচ গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খরচ হয়েছে কেবল ৬৭ হাজার ৫৫৩ কোটি ২১ লাখ টাকার মতো। ফলে বরাদ্দের বাকি ২ লাখ ১০ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে চার মাসে।,
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য বিগত অর্থবছরের তুলনায় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নয় মাসে পরিশোধ হয়েছে ৩২১ কোটি ২০ লাখ ডলার বৈদেশিক ঋণ। এর মধ্যে আসল পরিশোধ হয়েছে ২০১ কোটি ১০ লাখ ও সুদ ১২০ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ছিল ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। এর মধ্যে আসল ১৫১ কোটি ৬৬ লাখ ও সুদ পরিশোধ ছিল ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশী ঋণের বড় অংশই আসে বাজেট সহায়তায়। সরকারের রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় যে ঘাটতি থাকে সেটা পূরণ হয় মূলত বৈদেশিক ঋণ সহায়তা নিয়ে। বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান বড় আকারে কমে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে জনগণের সঞ্চয় করার প্রবণতা কমে গেছে। বৈদেশিক ঋণ সহায়তাকারী দেশগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে। স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধির আশা করা ঠিক হবে না। দাতারা ছয় মাস বা এক বছরের জন্য অর্থায়ন করে না।’