নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার নামে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বিদেশ সফরের হিড়িক পড়েছে। কমিশনাররা যাচ্ছেন ভোটার কার্যক্রম উদ্বোধন ও তদারকিতে, আর কর্মকর্তারা যাচ্ছেন প্রশিক্ষণ দিতে। এসব সফরে অভিজ্ঞ কারিগরি কর্মকর্তাদের বদলে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব সফরের অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর পরিহারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনাও কার্যত উপেক্ষিত হচ্ছে।
আইডিইএ প্রকল্প (পর্ব–২)–এর আওতায় প্রবাসী ভোটার কার্যক্রম বাস্তবায়নে কমিশনার ও কর্মকর্তারা এসব বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। ২০২৩ সালের শেষদিকে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রকল্প–১ থেকে ব্যয় নির্বাহের পর বর্তমানে প্রকল্প–২ থেকেই সফর ব্যয় বহন করা হচ্ছে।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতি কর্মকর্তার বিদেশ সফরে গড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়। নির্বাচন কমিশনারদের ক্ষেত্রে এই ব্যয় আরও বেশি। গত দুই বছরে এ খাতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটার নিবন্ধনের কাজের জন্য মূলত কারিগরি কর্মীরাই প্রয়োজন। প্রবাসীদের আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ স্ক্যান গ্রহণ এবং যন্ত্রপাতি স্থাপন ও প্রশিক্ষণ পরিচালনার কাজ তারা একাই করতে সক্ষম। তাই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতি বা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে ১০টি দেশের ১৭টি স্টেশনের মাধ্যমে প্রায় ৫৫ হাজার প্রবাসীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি প্রবাসী আঙুলের ছাপ দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন এবং ১১ হাজার ৬৩৩ জন ভোটারকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হয়েছে।
কার্যক্রমের পটভূমি
প্রবাসে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম প্রথম শুরু হয় ২০১৯ সালে, তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যে অনলাইনে ভোটার নিবন্ধনের কাজ শুরু হয় ওই বছরই। পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপেও এ কার্যক্রম চালু হয়।
করোনা মহামারির কারণে তা বন্ধ থাকলেও ২০২২ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০টি দেশে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী ভোটার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
দেশগুলো হলো—সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপান। আগামী মাস থেকে আমেরিকার পাঁচটি রাজ্যসহ ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান ও মালদ্বীপেও ভোটার নিবন্ধনের কাজ শুরু হবে।
কমিশনারদের সফর
গত মাসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন কানাডা সফর করেছেন প্রবাসী ভোটার কার্যক্রম পরিদর্শন ও এনআইডি বিতরণ উদ্বোধনের জন্য। তার সঙ্গে ছিলেন লালমনিরহাট জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা লুৎফুল কবির সরকার।
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সফর করেছেন মালয়েশিয়ায়, আর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ গেছেন ফ্রান্সে। আগামী অক্টোবর মাসে তিনি যাচ্ছেন সুইডেনে। কমিশনার তাহমিদা আহমদ যাচ্ছেন মরক্কোয় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে।
কর্মকর্তাদের সফর
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ ও এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে দুটি টিম গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি শহরে (মায়ামি, লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি) সফর করেছেন। এছাড়া এনআইডি অনুবিভাগের পরিচালক খান আবি শাহনূর খান পাঁচ দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।
আগস্টে ইসি সচিব পাঁচ দিনের সফরে যান জাপানে, একই মাসে পাঁচ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল টিমও দেশটিতে সফর করে। এপ্রিল মাসে অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজের নেতৃত্বে টিম সফর করে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে। একই মাসে বিভিন্ন টিম অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় সফর করে।
চলতি মাসে ২৬ জন কর্মকর্তা মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, জর্ডান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওমান সফরে যাচ্ছেন।
ইসির ব্যাখ্যা
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “অপ্রয়োজনীয় হলে বিদেশ সফরের প্রয়োজন হতো না। কারিগরি টিম যাচ্ছে যন্ত্রপাতি স্থাপনে, আর কর্মকর্তারা যাচ্ছেন প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে। বিদেশে সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব নয়, তাই একসঙ্গে সব কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনেই সফর করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করতে হবে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতেই এই সফরগুলো হচ্ছে।”
ইসি সচিবের দাবি, “সফরে কর্মকর্তার সংখ্যা ও অবস্থানের সময় কমিয়ে ব্যয় সাশ্রয় করা হচ্ছে।”
এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীর বলেন, “দূতাবাস ও হাইকমিশনের মাধ্যমে এনআইডি সেবা চালুর জন্য প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পাঠানো হচ্ছে।”
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.