অনলাইন ডেস্ক: ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে ‘সাফল্য’ হিসেবে দেখছে ইসরায়েল। দেশটির নেতারা দাবি করছেন, যুদ্ধের মাধ্যমে তারা ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা, প্রতিরক্ষা সক্ষমতা দুর্বলকরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ফরদোর পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় রাজি করাতে পেরেছেন। তবে এতেই থেমে নেই তেলআবিব। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, "আমি গ্যাসের প্যাডেল থেকে পা সরানোর কোনো ইচ্ছা রাখি না"—অর্থাৎ তিনি আবারও হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আল-জাজিরা’র বরাতে একাধিক বিশ্লেষক জানিয়েছেন, ইসরায়েল এমন এক সুযোগ খুঁজছে, যাতে ইরানকে আরও দুর্বল করা বা দেশটির শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। তবে এ ধরনের অভিযানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি প্রয়োজন হবে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে সহজে মিলবে না বলে ধারণা করছেন অনেকে।
গত জুনের মাঝামাঝি আকস্মিক এক ইসরায়েলি হামলার মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা হয়। এতে ১ হাজারের বেশি ইরানি এবং ২৯ জন ইসরায়েলি নিহত হন। ইসরায়েল এই হামলাকে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ বলে দাবি করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা। তবে তেহরান বরাবরই বলে এসেছে, তাদের কর্মসূচি কেবল বেসামরিক উদ্দেশ্যে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, "আমরা ইসরায়েলের যেকোনো সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গভীরভাবে পাল্টা আঘাত হানতে প্রস্তুত।"
ইরান বিষয়ক বিশ্লেষক ত্রিতা পারসি মনে করেন, নেতানিয়াহু ইরানকে সিরিয়া বা লেবাননের মতো একটি 'দ্রুত হামলা সহনীয় রাষ্ট্রে' পরিণত করতে চান, যেখানে ইসরায়েল প্রয়োজন মতো হামলা চালাতে পারে, তেমন কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছাড়াই।
তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েল যুদ্ধ ফের শুরু করতে চায়, যাতে ইরানকে ক্রমাগতভাবে আঘাত করার জন্য উন্মুক্ত রাখা যায়।”
বিশ্লেষকদের মতে, ইউরোপীয় দেশগুলো যদি ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে ইসরায়েল সেটিকে একটি নতুন যুদ্ধের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। আলোচনা অনুযায়ী, আগস্টের মধ্যে নতুন চুক্তি না হলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হতে পারে।
২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির আওতায় যেসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তা ফেরার শঙ্কায় ইরান হয়তো চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াতে পারে—এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন পারসি। তখন ইসরায়েলের সামনে আবারও রাজনৈতিকভাবে হামলার সুযোগ তৈরি হবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ইসরায়েল হয়তো ইতোমধ্যে ইরানের অভ্যন্তরে গোপন নাশকতা অভিযান শুরু করেছে। বিভিন্ন আবাসিক ভবন, তেল শোধনাগার, বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা ও কারখানায় ঘটে যাওয়া রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা তৎপরতা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, “ইসরায়েল ইরানে যে গোয়েন্দা কাঠামো গড়ে তুলেছে, সেটি মাঝে মাঝে সক্রিয় রাখতে হয়—অনেক সময় তা কৌশলগত কারণ নয়, শুধু উপস্থিতির জানান দিতেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।”
গাজায় চলমান অভিযানের মধ্যেও নেতানিয়াহু সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এবং ইরানের ওপর আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের মুখে নতুন করে ইরানবিরোধী যুদ্ধ শুরু হলে, ইসরায়েলি জনগণের সমর্থন অর্জনের কৌশল হিসেবেও তা ব্যবহৃত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, “ইরান ইস্যুতে ইসরায়েলে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই নেতানিয়াহুর জন্য বড় প্রশ্ন।”
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআইপি-এর ইরান বিশ্লেষক নেগার মরতাজাভি বলেন, “ইরান জানে, নতুন কোনো পারমাণবিক চুক্তি হলে ইসরায়েলি হামলার সম্ভাবনা কমে যাবে। তারা কূটনৈতিক সমাধান চায়, তবে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত রয়েছে।”
ইপেপার
Copyright © 2025 ThikanaTV.Press. All rights reserved.