
আর শরীয়তের পরিভাষায় ইতেকাফ হচ্ছে দুনিয়াবি সকল প্রকার কার্যকলাপ থেকে আলাদা হয়ে শুধুমাত্র মহান বরের সন্তোষ অর্জনের লক্ষে মসজিদ কিংবা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে।
রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতে হবে।
ইতেকাফে থাকাকালীন কোনো ধরনের অহেতুক কথা-বার্তা, দুনিয়াবী লেন-দেন, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকরি-বাকরি সহ যে কোনো কিছুই করতে পারবে না।
যেমনঃ ইতেকাফ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তোমরা মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় তাদের সাথে (তোমাদের স্ত্রীদের) সাথে সঙ্গম করো না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৭)
রাদ্দুল মুহতার-২ঃ ১৪১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে রমজানের শেষ দশকে অর্থাৎ ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ উদয় হওয়ার ইতেকাফ করাটাই সুন্নাতে মুযাক্কাদায়ে কিফায়া। মনে রাখতে হবে. যদি গ্রাম বা মহল্লার কেউ যদি ইতেকাফ না করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই গ্রাম/মহল্লার সবাই গুনাহগার হতে হবে।
ইতেকাফের প্রকারভেদঃ
ইতেকাফ ৩প্রকার- ১.ওয়াজিবঃ অর্থাৎ মান্নত করে যে ইতেকাফ করা হয়।
২.সুন্নাতঃ অর্থাৎ রামাদানের শেষ দশকে যে ইতেকাফ করা হয় তাকেই সুন্নাতে মুয়াক্কাদা( কিফায়) বলা হয়ে থাকে।
৩.মুস্তাহাবঃ এই দুই প্রকার ইতেকাফ ব্যতীত সাধারণত যে ইতেকাফ করা হয়, তাকেই মুস্তাহাব ইতেকাফ বলে, এবং মুস্তাহাব ইতেকাফ যে কোনো সময়ে রাখা যায়, তবে মনে রাখবেনঃ সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও ওয়াজিব ইতেকাফে রোজা রাখতে হবে। ( ফাতওয়ায়ে আলমগীরী-১ঃ২১১পৃ.!! ফাতাওয়ায়ে শামী-২ঃ১৪১পৃ.)
ইতেকাফের উদ্দেশ্যঃ
মাহে রামাদানের শেষ দশকে ইতেকাফে থাকার মূল উদ্দেশ্য হলো রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভ করা, এবং সর্বোপরি আল্লাহর চূড়ান্ত নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে লাইলাতুল কদর তালাশ করা।
★রাসূল সাঃ প্রতি বছর রামাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছিলেনঃ
হাদিস শরীফের মধ্যে আসছে. হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ এর বর্ণনায় নবী কারীম সাঃ প্রতি রামাদানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন ঠিক সে বছর বিশদিন ইতেকাফ করেছিলেন। (সহীহ বুখারী.হাদিস নং-১৯১৬)
রাসূল সাঃ প্রতি রামাদানে ইতেকাফ করতেনঃ
হযরত আয়েশা রাঃ এর বর্ণনায় রাসূল সাঃ প্রতি রামাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছিলেন, এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি এই আমল করতেন, অতঃপর তার সহধর্মিণীগণও রামাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছিলেন ( বুখারী ও মুসলিম, বু.হাদিস নং-১৮৯৯)
এছাড়া মাহে রামাদানের শেষ দশকে লাইলাতুলকদর তালাশ করার সুযোগ রয়েছেঃ
হযরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, তোমরা মাহে রামাদানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুলকদর তালাশ কর। (বুখারী-মুসলিম, বু.হাদি সনং-১৮৯০)
মহিলারা ঘরে ইতেকাফ এবং পুরুষগণ মসজিদে-
মহিলাদের ঘরে ইতেকাফ করতে পারবেঃ
এই বিষয়ে ২টি হাদিসঃ
হযরত আয়েশা রাঃ এর বর্ণনায় রাসূল সাঃ প্রতি রামাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছিলেন, এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি এই আমল করতেন, অতঃপর তার সহধর্মিণীগণও রামাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছিলেন ( বুখারী ও মুসলিম, বু.হাদিস নং-১৮৯৯)
হযরত আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত, একবার নবী কারীম সাঃ ইতেকাফ করার ইচ্ছে করলেন, এরপর তিনি যে স্থানে ইতেকাফ ইচ্ছে করেছিলেন সেখানে গিয়ে কয়েকটি তাঁবু দেখতে পেলেন। তাঁবুগুলো ছিলো হযরত আয়েশা, হাফসা ও যায়নাব রাঃ এর। তিনি বললেন, তোমরা কি এগুলো দ্বারা সাওয়াব পাওয়ার ধারণা কর? এরপর তিনি ইতেকাফ না করে চলে গেলেন। এবং পরবর্তী শাওয়াল মাসে দশদিন ইতেকাফ করলেন। ( সহীহ বুখারী.হাদিস নং-১৯০৬)
অত্র হাদিস থেকে একটি মাসয়ালাঃ
আলোচ্য হাদিস দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায় যে. মহিলাদের জন্য মসজিদে ইতেকাফ করা জায়িয নেই, তবে মহিলারা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে ইতেকাফ করতে পারবে, আর ইতেকাফ ইতেকাফ অবস্থায় নারীদের হায়েয বা নিফাস শুরু হলে ইতেকাফ ছেড়ে দিবে। ( আহসানুল ফাতাওয়া-৪ঃ ৫০২পৃ.)
ইতেকাফ সংক্রান্ত মাসায়িলঃ
মাসয়ালা-১ঃ ইতেকাফ পালনরত অবস্থা বিনা প্রয়োজনে সামান্য সময়ের জন্যেও বাহির হওয়া নিষিদ্ধ, তবে প্রয়োজন হলে ভিন্ন কথা- যেমনঃ অজু গোসল, বাধরুম ও জুমার নামাজের জন্যে শরীয়তের অনুমতি রয়েছে, এবং প্রয়োজনীয় কাজ শেষে দ্রুত ইতেকাফের স্থানে ফিরে আসতে হবে। ( ফাতাওয়ে আলমগীরী-১ঃ২১২পৃ.!! আহসান ফাতাওয়া-৪ঃ৫০১পৃ.)
মাসয়ালা-২ঃ ইতেকাফ করা অবস্থায় বেশি অসুস্থ হলে ইতেকাফ ছেড়ে দিয়ে বাহিরে চিকিৎসা নিতে পারবেন, এতে কোনো প্রকার গুনাহ হবে না, তবে পরবর্তীতে সে শুধু ঐ দিনের জন্যেই ইতেকাফ কাযা করতে হবে। ( ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী-১ঃ ২১২পৃৃ.!!আহসানুল ফাতওয়া-৪ঃ৫০৮পৃ.)
মাসয়ালা-৩ঃ নারীদের জন্য মসজিদে ইতিকাফ জায়েজ নাই, তবে নারীরা চাইলে ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে ইতেকাফ করতে পারেন, আর ইতিকাফ অবস্থায় হায়েজ কিংবা নেফাস শুরু হলে ইতেকাফ ছেড়ে দিবে।( আহসানুল ফাতাওয়া-৪ঃ৫০২পৃ.)
মাসয়ালা-৪ঃ অনেক মসজিদে টাকা দিয়ে ইতেকাফ করানো হয় আমাদের দেশে, আর এর দ্বারা বিনিময় গ্রহণের ফলে ইতিকাফ জায়েজ হবে না, এবং এর দ্বারা সকলেই গুনাহগার হবে।
( ফাতাওয়ায়ে শামী-২ঃ১৯৯পৃ. ফাতাওয়ায়ে রহমানিয়া-১ঃ৪৫৮পৃ.)
ই’তিকাফের পূর্ব প্রস্তুতিঃ
– পরিবারের জন্য ঈদের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।
– ফিতরা আদায়ের যথাযথা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
– পরিবারের ব্যয়ভার বহনের জন্য সুব্যবস্থা করা।
– মসজিদে ইফতার ও সাহরি পৌছানোর জন্যে ব্যক্তি নির্ধারণ কিংবা মাধ্যম প্রস্তুত করা।
– দুনিয়াবি জরুরি সম্ভাব্য কাজের সমাধানের জন্য আগাম ব্যবস্থা করতে হবে।
– পারিবারিক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যবস্থা নির্ধারণ করে যাওয়া।
পরিশেষে…
মহান আল্লাহ তাআলা গোটা মুসলিম উম্মাহকে নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে ইতেকাফে পালনের মাধ্যমে মহান বরের সন্তোষ অর্জন করার তাওফিক দান করুন, এবং ইতেকাফের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হাসিলের তাওফিক দান করুন। পাশাপাশি করোনা সহ বিভিন্ন মহামারি থেকে মহান রব সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক: মোয়াজ্জেম বিন মোশাররফ, ফেনী।
খতীবঃ মসজিদে আকসা, পৌর ৯নং ওয়ার্ড, লক্ষীপুর।