
দরপত্র ছাড়াই কাজ, নিম্নমানের নির্মাণে ঘর হস্তান্তর, ঘুষ-তদবিরে তালিকা, পরিত্যক্ত প্রকল্পে গবাদিপশু পালন
নিজস্ব প্রতিবেদক: ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাথার ওপর ছাদ দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে গৃহীত প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প দেশজুড়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট দরপত্র ছাড়াই কাজ বাস্তবায়ন, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ এবং ঘুষের বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফলে বছর না ঘুরতেই বহু ঘর ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোথাও ঘরের চালা উড়ে গেছে, দেয়ালে ধরেছে ফাটল, আবার কোথাও তালাবদ্ধ ঘরে চলছে ছাগল পালন। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, চূয়াডাঙ্গা, শরীয়তপুর ও লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় এই প্রকল্পের হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে।
প্রকল্পের প্রেক্ষাপট
ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসনে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পটি গ্রহণ করে। পরবর্তীতে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সাল থেকে জোরেশোরে ঘর নির্মাণ শুরু হয়। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২৯ লাখ মানুষকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এলাকাভিত্তিক সরেজমিন চিত্র
রংপুরের পীরগাছা: মাটি ভরাটেই দেড় কোটি টাকা লোপাট
পীরগাছায় ৪৩০টি ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন ইউএনও নাজমুল হক সুমনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, তিনি পরিপত্র অমান্য করে ৫-৬ ফুটের বদলে মাত্র দেড়-তিন ফুট মাটি ভরাট করেন এবং অবৈধ ড্রেজার ব্যবহার করে প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। অতিরিক্ত মাটি বিক্রি করে আরও চার কোটি টাকা আয় করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ঘর বরাদ্দের জন্য ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব দেননি।
বগুড়ার ধুনট: ৭৮টি ঘরের তথ্যই গায়েব
ধুনটের সাবেক ইউএনও সঞ্চয় কুমার মোহন্তের বিরুদ্ধে ৭৮টি ঘরের টাকা আত্মসাৎ ও ঠিকাদার নিয়োগ ছাড়াই কাজ করানোর অভিযোগ উঠেছে। মোট ৩৯৯টি ঘরের মধ্যে ৭৮টির বরাদ্দ বা সুবিধাভোগীর কোনো তথ্যই উপজেলা দপ্তরে সংরক্ষিত নেই। স্থানীয় ইটভাটার মালিকদের অভিযোগ, বিনামূল্যে ইট না দেওয়ায় তৎকালীন ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের জরিমানা করেছিলেন। তবে অভিযুক্ত কর্মকর্তা সঞ্চয় কুমার মোহন্ত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা: নির্মাণেই ফাটল, মালামাল লোপাট
দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গায় ২৬৪টি ঘর নির্মাণের দুই মাসেই দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই চাল দিয়ে পানি পড়ে। মর্জিনা খাতুন নামে এক বাসিন্দা বলেন, “আগে টিন শেডের ঘরেই ভালো ছিলাম। নতুন ঘরের চালা ঝড়ে উড়ে গেছে।” অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন ইউএনও মমতাজ মহল দরপত্র ছাড়াই পুরনো প্রকল্পের টিন, লোহা ও ইট বিক্রি করে দিয়েছেন।
ঢাকা ও শরীয়তপুর: তালাবদ্ধ ঘরে ছাগল পালন
ঢাকার ধামরাইয়ে নির্মিত ৬৫০টি ঘরের একটি বড় অংশ পরিত্যক্ত। বহু পরিবার ঘর বিক্রি করে চলে গেছে। কেরানীগঞ্জে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সচ্ছল ও জেলা পরিষদের কর্মচারীদের ঘর দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, ফলে ৪৫টি ঘরের বেশিরভাগই তালাবদ্ধ। অন্যদিকে, শরীয়তপুরের ডামুড্যায় ২১৩টি ঘরের মধ্যে বহু ঘর খালি পড়ে আছে এবং কয়েকটিতে ছাগল পালন করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ও লক্ষ্মীপুর: ঘর বিক্রি ও দখলের উৎসব
চট্টগ্রামের রাউজানে ১৩০টি ঘরের বেশিরভাগই বরাদ্দপ্রাপ্তদের বদলে অন্যদের দখলে। অন্তত ৫০ জন তাদের ঘর হস্তান্তর করেছেন এবং ৪০টি ঘর তালাবদ্ধ। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬৯টি ঘর প্রায় এক বছর ধরে তালাবদ্ধ এবং স্থানীয় দালাল ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যারা এগুলো ভাড়া বা বিক্রি করে দিচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
বিভিন্ন উপজেলার বর্তমান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন। রাউজানের ইউএনও জিসান বিন মাজেদ বলেন, “যাঁরা অনিয়ম করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে এবং খালি ঘরগুলো নতুন আবেদনকারীদের দেওয়া হবে।” লক্ষ্মীপুরের ইউএনও রাহাত উজ জামানও জানান, প্রকৃত অসহায়দের ঘর প্রদানে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।