
নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় নেয়া বিপুল বৈদেশিক ঋণের বোঝা ও বিতর্কিত মেগা প্রকল্পগুলো পর্যালোচনায় এখন আপসের পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ‘অডিয়াস ডেট’ হিসেবে পরিচিত এইসব ঋণের বৈধতা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও বাংলাদেশ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান নেয়নি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যে প্রকল্পগুলো জনস্বার্থবিরোধী, অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিপরায়ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, তার দায় জনগণের ওপর চাপানো অনৈতিক। এমন প্রকল্পের ঋণ ‘অডিয়াস’ বিবেচনায় ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই পুনর্গঠন বা মওকুফের উদ্যোগ নেয়া যায়—বিশ্বে যার একাধিক নজির রয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সাতটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয় প্রাক্কলনের তুলনায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে। কোনো কোনো প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত। অনিয়ম ও লুটপাটের এ চিত্র সরকারিভাবেই স্বীকার করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, “যে প্রকল্পে জনসেবা না হয়ে রাজনৈতিক ফায়দা বা লুটপাট হয়েছে, তার দায় জনগণের নয়। এ ধরনের ঋণ আন্তর্জাতিকভাবে অডিয়াস ডেট হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে।”
বিশ্বজুড়ে এমন ঋণ বাতিল বা পুনর্গঠনের দৃষ্টান্ত রয়েছে—২০০৮ সালে ইকুয়েডরে, ২০০৩ সালে ইরাকে, এমনকি শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের ঋণও পরবর্তীতে পুনর্গঠনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। অথচ বাংলাদেশ এখনো দাতাদের সঙ্গে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত প্রকল্পগুলো বন্ধ না করে এখন ব্যয়সংকোচনের পথ বেছে নিচ্ছে সরকার। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক ভারসাম্যও রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
শ্বেতহস্তী প্রকল্প হিসেবে পরিচিত কর্ণফুলী টানেল ও পায়রা বন্দরের মতো প্রকল্পগুলোতে বিপুল ঋণ নেয়া হলেও কার্যকারিতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। টানেল থেকে টোল আদায় আশানুরূপ না হওয়ায় ঋণ পরিশোধে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। পায়রা প্রকল্প নিয়েও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একে অর্থনীতির “বিষফোড়া” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ব্যয় ও উৎপাদন খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের সমতুল্য প্রকল্পের তুলনায় রূপপুরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোর ব্যয় সংশোধন এবং দাতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ চলছে। তবে হঠাৎ করে প্রকল্প বাতিল নয়, বরং যৌক্তিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, “সরকারের উচিত অডিয়াস ঋণ প্রমাণসহ দাতাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে যাওয়া, যাতে ভবিষ্যতের চাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়।”
বিতর্কিত ঋণচুক্তি, প্রকল্প বিলাস ও দুর্নীতির দায়ে জনগণকে না ফেলে অন্তর্বর্তী সরকার এখন কৌশলী পদক্ষেপ নিচ্ছে—যার লক্ষ্য অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং আন্তর্জাতিক চাপ হ্রাস করা।