ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: পবিত্র কুরআনে প্রথম মানব হিসেবে আদম-হাওয়া বা ইংরেজিতে অ্যাডাম-ইভের নাম আসে। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গের একদম প্রথমদিকের সূত্রও আছে সেখানে। আদম আ: এর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিল (কুরআন), ইংরেজিতে Able & Cain (পুরাতন বাইবেল) ছিল যথাক্রমে রাখাল ও কৃষক। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে দুই ভাই একটি করে কুরবানি হাজির করেছিল যার একজনেরটা কবুল হয় বলে উল্লেখ রয়েছে কুরআনে।
পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আদি পিতা আদম আ: জোড়ায় জোড়ায় সন্তান জন্ম দিতেন। প্রতি জোড়ায় একজন মেয়ে এবং একজন ছেলে সন্তান আসত। যাদের মধ্যে আদম আ: আগের জোড়ার ছেলে এবং পরের জোড়ার মেয়ে কিংবা আগের জোড়ার মেয়ে এবং পরের জোড়ার ছেলের সাথে বিয়ে দিতেন। এরই ধারাবাহিকতায় কাবিলের সাথে জন্ম নিয়েছিল ইকলিমা এবং হাবিলের সাথে জন্ম নিয়েছিল ইওয়াজা।
ফলে কাবিলের কুরবানি কবুল না হওয়ায় মানুষের কাছে তার সম্মানহানি হওয়ার অভিযোগ এনে সে হাবিলকে হত্যা করে। মূলত ইসলাম ধর্মের কুরবানির ইতিহাস তখন থেকে শুরু হয়। যদিও পরবর্তীতে ইবরাহীম আ: এর ছেলে ইসমাঈল আ: কুরবানি হওয়ার ঘটনা থেকে অনুসারীরা অনুপ্রাণিত হয়ে ইনলাম ধর্মের অনুসারীরা কুরবানি করে থাকে।
ইকলিমা দেখতে বেশি সুন্দরী ছিল এবং ইওয়াজা দেখতে কম সুন্দরী ছিল। নিয়ম অনুযায়ী হাবিল ইকলিমা এবং কাবিল ইওয়াজাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত হলে কাবিল তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, আমার সাথে যে মেয়ে জন্ম নিয়েছিল আমি তাকে বিয়ে করব। সমস্যা সমাধানে হজরত আদম আ: ছেলেদেরকে বললেন, তোমরা আল্লহর জন্য কোরবানি কর। পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ২৫ এবং ২৬ নং আয়াতে এ বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায়।
হজরত আদম আ: এর নির্দেশ অনুযায়ী হাবিল তার পালের শ্রেষ্ঠ মেষ নিয়ে যায়, আর কাবিল নিয়ে যায় নিজ ক্ষেতের কিছু শস্য। এর মাঝে হাবিলেরটা গ্রহণ করা হয়, কাবিলেরটা নয়। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, হাবিল যেমন শ্রেষ্ঠ উপকরণ বেছে নিয়েছিল, কাবিল তেমনটি করেনি। ফলে কাবিলের কুরবানি কবুল না হওয়ায় মানুষের কাছে তার সম্মানহানি হওয়ার অভিযোগ এনে সে হাবিলকে হত্যা করে। মূলত ইসলাম ধর্মের কুরবানির ইতিহাস তখন থেকে শুরু হয়। যদিও পরবর্তীতে ইবরাহীম আ: এর ছেলে ইসমাঈল আ: কুরবানি হওয়ার ঘটনা থেকে অনুসারীরা অনুপ্রাণিত হয়ে ইনলাম ধর্মের অনুসারীরা কুরবানি করে থাকে।
ইসলাম ধর্মে কুরবানির আনুষ্ঠানিক রীতির বিষয়টি অন্য ধর্মে কীভাবে রয়েছে’? বিশেষত হিন্দু ধর্ম, ইহুদি ধর্ম ও খ্রিষ্টধর্মে পশু উৎসর্গের রীতি বা প্রচলন সম্পর্কে কেমন ব্যাখ্যা রয়েছে?
হিন্দু বা সনাতন ধর্ম
হিন্দু ধর্মে পশু বলি বিষয়টা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মতভেদ থাকলেও এর চর্চা যে নেই তেমনটাও নয়। যেমন বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই দুর্গাপূজা বা কালীপূজা ছাড়াও অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে পশু বলি দেয়া হয়। বিশেষত ‘শাক্ত’ মতাবলম্বী, অর্থাৎ ‘শক্তি’ বা দেবীকেন্দ্রিক উপাসনায় এই প্রথার প্রচলন রয়েছে।
বেদ থেকে সনাতন ধর্মের দুই ধরনের উপাসনা পদ্ধতি আসে, সাকার ও নিরাকার। সাকারের মধ্যে পাঁচটি মতের একটি শাক্ত। আর বাঙালিদের মধ্যে শাক্ত মতাবলম্বী বেশি থাকায় দুর্গাপূজা বা কালীপূজার প্রাধান্য দেখা যায়। বাঙালিদের অনেক প্রাচীন মন্দিরগুলোতে এখনও বলির প্রচলন দেখা যায়।
ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় হিন্দু ধর্মে যেটি বহুল আলোচিত সেটি অশ্বমেধ যজ্ঞ। ভারতের পৌরাণিক বিষয়ক লেখক ড. রোহিণী ধর্মপাল রামায়ণ ও মহাভারতের উদাহরণ দিয়ে বিবিসিকে বলেন, সেই যজ্ঞের নিয়মটাই ছিল যে ঘোড়া ছেড়ে দেয়া হতো, এবং যিনি সম্রাট হবেন তার প্রতিনিধিরা সেই ঘোড়ার সঙ্গে থাকতেন।
সেই ঘোড়া যে যে রাজ্য ঘুরবে, সেই রাজ্যগুলির লোক যদি ঘোড়াকে আটকাতো তাহলে যুদ্ধ হতো ঐ রাজার প্রতিনিধির সঙ্গে। কোনও রাজ্যে যদি ঘোড়াকে না আটকানো হতো তাহলে ধরে নেয়া হতো এই ঘোড়াটি বা সেই রাজা এই রাজ্যটিকে জয় করে নিচ্ছে। পরিক্রমা করে সেই ঘোড়াটি যখন ফিরতো, সেই ঘোড়াটিকে কিন্তু যজ্ঞের আগুনে দেয়া হতো এবং সেই মাংস সবাই খেতেন।
এছাড়া,’মহাভারতের সময়ও ব্রাহ্মণরাও মাংস খেতেন, রাম নিজেই রীতিমত ননভেজ মানুষ ছিলেন এবং মাংস ছাড়া থাকতে পারতেন না। যখন সীতাকে রাবণ নিয়ে চলে গেছিল তখন বিরহে মদ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কা এবং নেপালে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পশু বলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সেটা যে একেবারেই পালন হয় না তেমনটাও নয়।
ইহুদি ধর্ম
ইসলামের ইতিহাসের সাথে অনেকটাই মিল আছে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের। পশু উৎসর্গ বা কোরবানির দিকটা ইহুদিদের উৎসবেও আছে। ইহুদি ধর্মে মূলত ৩টি তীর্থযাত্রার উৎসব পেসাহ (Passover), শাভুওয়াত (Feast of Weeks, সপ্তাহের উৎসব), এবং সুখট (Feast of Tabernacles, কৃষি সংক্রান্ত উৎসব) এর সাথে পশু উৎসর্গের রীতির মাহাত্ম রয়েছে।
আর এর বাইরে ‘রশ হাশানাহ’ বা ইহুদি নববর্ষ এবং ‘ইয়ম কিপুর’ (Day of Atonement, প্রায়শ্চিত্তের দিন), এমন সব উৎসবেই পশু উৎসর্গের রীতি থাকার কথা উল্লেখ করেন যুক্তরাজ্যের একজন ইহুদী পণ্ডিত বা র্যাবাই গ্যারি সমারস, যিনি লিও বিক কলেজের একাডেমিক সার্ভিসের প্রধান।নমুসলিমদের কোরবানির ইতিহাসের সাথে যে নবী ইবরাহীমের ঘটনা আসে, সে ইতিহাস ইহুদি ধর্মগ্রন্থেও রয়েছে। তবে ইহুদিদের জন্য পশু উৎসর্গের নির্দেশ আসে আরও পরে একটু ভিন্নভাবে।
সেসময় ভেড়া কোরবানি দিয়ে তার রক্তচিহ্ন দরজার বাইরে এঁকে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়, যেন মৃত্যুর দূত মিশরের প্রথমজাত সন্তানকে নিতে আসলে তারা সেই চিহ্ন দেখে ইসরায়েলিদের চিনে তাদেরকে বাদ দিতে পারে, এভাবেই প্রথমবারের মতো পশু উৎসর্গের নির্দেশ আসে যেটা ‘পেসাহ’ বা ‘পাসওভার’ হিসেবে পরিচিত হয়।
প্রাথমিক ইতিহাসের দিকে দেখলে যেমনটা তোরাহ বা তাওরাতে উল্লেখ রয়েছে, ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে মিশরের ফারাও বা ফেরাঊন রাজারা ইসরায়েলাইটস নামে একদল ইহুদিকে দাস করে রেখেছিল। ইহুদি ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ নবী মোশি (আরবীতে মূসা, গ্রীক মোসেস’) ফারাওদের কাছে বেশ কয়েকবার দাসকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেন। এরপর বলেন যদি তাদের মুক্তি না দেয়া হলে ঈশ্বর মিশরীয়দের উপর মহামারী ঘটাবেন। ফেরাউনরা না মানায় মহামারী আসে। সে সময়ের দশটি মহামারীর একটি ছিল মিশরীয় পরিবারে প্রথম জন্ম নেওয়া শিশুটিকে মৃত্যুর দেবদূতের হাতে হত্যা।
সেসময় ভেড়া কোরবানি দিয়ে তার রক্তচিহ্ন দরজার বাইরে এঁকে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়, যেন মৃত্যুর দূত মিশরের প্রথমজাত সন্তানকে নিতে আসলে তারা সেই চিহ্ন দেখে ইসরায়েলিদের চিনে তাদেরকে বাদ দিতে পারে, এভাবেই প্রথমবারের মতো পশু উৎসর্গের নির্দেশ আসে যেটা ‘পেসাহ’ বা ‘পাসওভার’ হিসেবে পরিচিত হয়। তবে ইহুদি ধর্মে পশু উৎসর্গের অনেক ধরনের রীতিনীতি এবং নিয়মকানুন রয়েছে যেগুলো উদ্দেশ্যভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
খ্রিষ্টধর্ম
ইহুদি ধর্মের সূত্র ধরে খ্রিস্টধর্ম আসায় খ্রিষ্টধর্মের যে পুরনো বাইবেল রয়েছে তার সাথে অনেকটাই মিল রয়েছে ইহুদি ধর্মগ্রন্থের। ইহুদিদের যে ‘পাসওভার’ রীতি সেটার জায়গা খ্রিস্টধর্মেও রয়েছে, যদিও এর ব্যাখ্যা বা পালনের ধরন ভিন্ন। সময়টা কাছাকাছি হলেও খ্রিষ্ট পাসওভার বলতে নিস্তারপর্ব বা যিশুখ্রিষ্টের পুনরুত্থানের মাহাত্ম্য থেকে দেখা হয়।
পুরাতন নিয়মের মধ্যে যে কয়েকটা বই আছে বিশেষত লেবীয় পুস্তকের ১৭ অধ্যায় এবং দ্বিতীয় বিবরণে এ বিষয়গুলো উল্লেখ আছে যে, কী রকম পশু বলি দিতে হবে। ওটা দেয়া হতো সকালে এবং বিকেলে, বিভিন্ন উৎসবে এবং অনেক পশু দেয়া হত। সেসময় ঐ পশু বলি দিয়ে নেতিবাচক প্রবণতার বিপরীতে অনুতাপ প্রকাশ এবং ক্ষমার আশায় এমনটা করা হতো।
তবে সেই রীতির প্রচলন এখন আর ধর্মীয়ভাবে নেই কারণ যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুকেই মূলত সবচেয়ে বড় উৎসর্গ হিসেবে দেখা হয়। যিশু খ্রিষ্টকেই খ্রিষ্টধর্মে ‘ল্যাম্ব অফ গড’ বা ঈশ্বরের মেষশাবক হিসেবে দেখা হয়। তবে মাংস খাওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ নেই। অনেক দেশে উৎসবের অংশ হিসেবে পাসওভারে মেষের মাংস খাওয়ার রীতিও রয়েছে। যেমন মিঃ রিবেরুর ইতালি থাকার অভিজ্ঞতায় ইস্টারের আগে পাসওভার মেষের মাংস খাওয়াটা অনেকটা বাধ্যতামূলক মনে হয়েছে। তবে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে কোরবান বা পশু বলিদানের রীতি খ্রিষ্টধর্মে নেই।’