ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এই তিন মাসের পর সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে, তা হল এই সরকার আসলে কে চালাচ্ছে? রাস্তাঘাটে, হাটে-মাঠে, সচিবালয়ে কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সকলের একই প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত কোথা থেকে আসছে? সকাল-বিকাল কেন এতো সমস্বয়হীনতা? সিংহাসনের পেছনে কার ছায়া? ড. মুহাম্মদ ইউনূস কী আসলেই দেশ চালাচ্ছেন? তিনি কী সব ক্ষমতার উৎস? নাকি পেছন থেকে অন্য কেউ কলকাঠি নাড়ছে। অনেকেই মনে করেন ড. মুহম্মদ ইউনূসকে একজন ‘প্রতীকী প্রধান উপদেষ্টা’ হিসেবে সামনে রাখা হয়েছে, নেপথ্যে থেকে অন্য কারা যেন সব কলকাঠি নাড়ছেন। বিশেষ করে একজন উপদেষ্টার নাম শোনা যায়। তাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছাতেই নাকি সব কিছু হয়। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ, বিশেষ সহকারীকে আবার উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে আসা ইত্যাদি সবই নেপথ্যের কারিগরের কাজ, যিনি এই সরকার গঠনে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সরকারের চাবি নাকি তাঁর হাতে। কিন্তু এই যুক্তিও অনেকের মতে ধোপে টেকে না। সরকারের সব ক্ষমতা তাঁর কাছে নেই। সব ক্ষমতা যদি ওই উপদেষ্টার কাছে থাকত, তাহলে তিনি তো রাষ্ট্রপতিকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় দিতেন। রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দেয়ার আয়োজনও তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। সংবিধান উঁচিয়ে ধরে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ দুজন উপদেষ্টা আওয়াজ তুলেছিলেন রাষ্ট্রপতির সরে যাওয়ার বিষয়টি আসলে সাংবিধানিক নয়, এটি রাজনৈতিক। কাজেই বোঝা যায় যে উপদেষ্টামণ্ডলীতে ওই উপদেষ্টা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান থাকলে, তাঁর নিয়ন্ত্রিত উপদেষ্টামণ্ডলীর সংখ্যা বেশি হলেও তিনি আসলে সিংহাসনের পেছনে ‘ছায়া’ নন। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার চাণক্যও নন।
বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় দেখা গেছে যে মূল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী, সরকার প্রধান বা রাজনৈতিক সরকারের হাতে থাকলেও দেশ চালান আমলারা। আমলাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় সবকিছু। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১৮ সালের পর থেকে মনে হয়েছিল যে, দেশে ‘আমলাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবুল কালাম আজাদ, ড. আহমদ কায়কাউসরা মন্ত্রীদের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন। জেলার দায়িত্ব আমলাদের দেয়া হয়েছিল। এবার অবশ্য তেমন নয়। এবার আমলাদের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি মধুসূদনের মতোই। বরং তার চেয়ে খারাপই। সকালে চাকরী করা আমলার চাকরী বিকেল বেলা নেই। কয়েকদিন আগে একজন আমলা বিদেশে গেলেন সরকারি সফরে। ফিরে এসে তাঁর হাতে চিঠি ধরিয়ে দেয়া হল, তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হল। আমলাদের স্বাভাবিক পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে ১২ বছরের পুরনো আমলাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। এই ১৫ বছরে যে দেশের পরিবর্তন হয়েছে সেই পরিবর্তন সম্পর্কে যাঁদের ধারণা নেই- এমন একজন আমলাকে সচিব করা হয়েছে, যিনি এখন পর্যন্ত ই-ফাইলিং বুঝে উঠতে পারেননি। কারণ তিনি যখন অবসরে গেছেন তখন ই-ফাইলিং ব্যবস্থার প্রবর্তনই ছিল না। কাজেই সিংহাসনের পেছনের ছায়াটি আমলাতন্ত্র নয়- এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
অনেক সময় এই ধরণের সরকারে বঙ্গভবন রাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। কিন্ত এবারের অবস্থা মোটেও সেরকম নয়। রাষ্ট্রপতি নিজেই কঠিন অবস্থার মুখোমুখি। তিনি থাকবেন কি থাকবেন না-এ নিয়ে একটা টলটলায়মান পরিস্থিতি। কাজেই রাষ্ট্রপতি যে ক্ষমতা কেন্দ্রের চারপাশে নেই- এটা বোঝার জন্য কোন পণ্ডিতের প্রয়োজন নেই। এখন থাকে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী কী রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করছে বা সেনাবাহিনী কী এই সরকারকে পরিচালিত করছে? একথা ঠিক যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন সম্ভব হয়েছিল সেনাবাহিনীর ভূমিকার কারণে। শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরস্ত্র শিক্ষার্থী এবং জনতার উপর গুলি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এই অস্বীকৃতি জানানোর বার্তাটি সেনাপ্রধান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেয়ার পরেই আসলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পথ ত্বরান্বিত হয়ে। তারপর সরকার ৪৮ ঘণ্টাও টেকেনি। সেনাবাহিনীর অবস্থান আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এখনও রাষ্ট্রক্ষমতা বা সরকারকে পরিচালনা করা বা সরকারকে সরকারকে নির্দেশনা দেয়ার মতো কোন রকম ইঙ্গিত সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পাওয়া যায়নি। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেদিক থেকে এক এগারোর সরকারে থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এক এগারোর সময় যেমনটি আমরা দেখেছি যে, এক এগারো সরকারের বিষয়টি ছিল প্রকাশ্য সেনা নিয়ন্ত্রিত। সেনাবাহিনী যেভাবে চাইছে, সেভাবে সরকার পরিচালিত হতো। বিশেষ করে জেনারেল মঈন উ আহমেদ অঘোষিত সরকার প্রধান ছিলেন। এবার পরিস্থিতি মোটেও এমনটি নয়। কাজেই সেনাবাহিনী এই সরকারকে সহযোগিতা করছে বটে, কিন্তু সরকারের ভালোমন্দের কোন হিস্যা বা ভালোমন্দের কোন দায়দায়িত্ব সেনাবাহিনী গ্রহণ করছে না বলেই প্রতীয়মান হয়।
এরপরে আসে এই গণ-অভ্যুত্থানের মূল শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা কী নেপথ্যে থেকে সরকার পরিচালনা করছে? এ কথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্তত তিনজন সমন্বয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন। সমন্বয়কদের গুরু হিসেবে পরিচিত ড. আসিফ নজরুল উপদেষ্টামণ্ডলীতে আছেন। কাজেই ছাত্রদের একটা বড় প্রভাব সরকারের ভেতর আছে। কিন্তু সমন্বয়কদের সব কথাই যে সরকারের কথা হচ্ছে বা সমন্বয়করাই যে সরকার চালাচ্ছে-এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনায় এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়, জাতীয় পার্টির সম্পর্কে মনোভাব, এমনকি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হোঁচট খেয়েছে। তাছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব এবং জনপ্রিয়তাও আগের থেকে কমতে শুরু করেছে। কাজেই সরকারের ওপর তাঁদের বড় ধরনের প্রভাব এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, বরং প্রভাব কমছে। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও কয়েক ধরনের ধারা রয়েছে এবং সকল ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় যে রকম অভিন্ন এবং ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে ছিল এখন তাদের অভিন্ন অবস্থানের ক্ষেত্রে চিড় ধরেছে।’
কেউ মনে করেন যে এই সরকারের ক্ষমতায় আসার পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন, ফরহাদ মজহারের মতো চিন্তক এবং তাত্ত্বিকদের একটা ভূমিকা ছিল। তাঁরাও এখন সরকারের নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রাখছেন। তাঁরাই হলেন এই সরকারের চাণক্য। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে এখন হতাশার সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে এখন নানা রকম দুশ্চিন্তার কথা শোনা যায়। সরকার কি কি ভুল করছে- এ নিয়েও তাঁদের নিত্য আহাজারি আমরা শুনছি। কাজেই এই সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাক্টিভিস্টরা যে সিংহাসনের পেছনের ছায়া এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই।
এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে একটি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক নথিপত্রতে এই সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে তাঁদের ভূমিকার কথা জানা যায়। অনেকে মনে করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় খুব নিয়ামক হিসেবে পালন করেছিল। উপদেষ্টামণ্ডলীতে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আছেন, যাঁরা সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তো বটেই। আর অন্যদিকে বিভিন্ন সংস্কারের যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশন গুলোতে মার্কিনপন্থিদের এক ধরনের আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার কমিশনে সরাসরি মার্কিন অনুগত ব্যক্তিদেরকে প্রধান করা হয়েছে। এই বাস্তবতা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই সরকারকে সাজানো, সরকারের কর্ম পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য স্থির করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। এই সরকার কী করবে, না করবে পুরোটাই আসলে নির্ভর করছে মার্কিন মনোভাব এবং অভিপ্রায়ের উপর। সিংহাসনের পেছনে আসলে বাইরের ছায়াটাই মুখ্য হয়ে আছে।’