সাইদ হাফিজ
এক সময় চিনের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। মানুষ দু‘বেলা দু‘মুঠো খেতে পারতো না। অবস্থা এতটাই বেগতিক হয়ে পড়েছিলো যে, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তারা রাতের অন্ধকারে ঘরের দরজা বন্ধ করে সপরিবারে গাদা গাদা আফিম খেয়ে ঘুমের মধ্যে মরে থাকতো।
আজকে যদি আপনি বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি টোং দোকানের দিকে লক্ষ্য করেন,যেখানে দোকানদার একটি কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে দশটি মাত্র পণ্য নিয়ে বসে আছেন। যদি সাহস করে পণ্য দশটিকে কাত করেন তাহলে দেখতে পাবেন দশটির মধ্যে আন্তত এগারোটি পণ্যের পেছনে লেখা আছে Made in China ( এগারোটি বললাম কারণ ল্যাম্পটিও নিশ্চয় চাইনার-ই হবে ) ।
এটা সম্ভব হয়েছে কারণ যেদিন তারা না খেয়ে ক’ষ্ট পেয়েছিল সেদিন তাদের কেউ রিলিফ দেই নি।
এবারের ঈদে যে লোকটি তার পরিবার ও বাচ্চাদের সেমাই-ফিন্নি খাওয়াতে পারলো না ও নতুন কাপড় পরাতে পারলো না তার নিশ্চয় মাথায় থাকবে আগামি ঈদে রক্ত পানি করে হলেও তাকে এই সেমাই-চিনি ও নতুন কাপড় কেনার টাকা উপার্জন করতে হবে। কিন্তু না,আমাদের দেশের কিছু অতিউৎসাহিত সংগঠন,বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান,ফেসবুক সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেমাই-চিনি,নতুন কাপড় (যাকাতের নামে শাড়ি-লুঙ্গি ) ও কোরবানির নামে লাখ লাখ টাকার গরু-ছাগলের মাংস বিতরণ করেন। এমন কি সংগঠনের লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেগুলো পৌঁছেও দেন,যা মানুষের কাজ করার মানসিকতা নষ্ট করে দেয়।
যে ছোট্ট বাচ্চাটি রাস্তায় আপনার কাছে খাবার কেনার নামে টাকা চাইছে তাকে দেখলে মায়া হওয়াটা স্বাভাবিক এবং আপনি মাঝে মাঝে টাকা দিয়েও থাকেন । যে এতো সহজে টাকা পাচ্ছে সে কি বড় হয়ে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করতে চাইবে? সে কি ছিনতাই করবে না? ডাকাতি করবে না?
জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আমরা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে আছি কারণ কাজ করতে আমাদের বড় লজ্জা। কোন কাজই ছোট না। ডাক্তার লুৎফর রহমান বলেছেন, ‘হাতে কাজ করায় অগৌরব নেই কারণ অগৌরব হয় মিথ্যায়,মূর্খতায় আর নীচতায়’।
তাই সকলের উচিৎ নিজে কাজ করা ও অন্যকে কাজে উৎসাহিত করা আর যদি দান করতেই হয় তাহলে কি সেমাই-চিনির বদলে ঝুড়ি-কোদাল কিম্বা সুই-সুতা দিতে পারি না? যাতে সে কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং তাকে যেন পুনরায় হাত পাতা না লাগে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাদের হাত দিয়াছেন বেহেশত ও বেহেশতি চিজ উপার্জন করিবার জন্য,হাত পাতিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়’।
দুঃখের বিষয় হলেও সত্য আজকালকার দিনে আমাদের দেশে রিলিফের প্রচলনটা বাড়াবাড়ি রকমে বেড়ে গেছে। দান- ছাদকা, জাকাত-ফিতরা ও সাহায্যের নামে যা চলছে তাকে এক কথায় বালা যায় বেলল্লাপনা। ইসলামী শরীয়তে ভিক্ষাবৃত্তিকে মর্যাদার চোখে দেখা হয় না। একদিন মহানবী স.-এর কাছে একজন ভিক্ষা চেয়েছিলেন,মহানবী স. তাকে তার-ই (ভিক্ষুকের) কম্বল ও বাটি বিক্রি করে খাবার ও একটা কুড়াল কিনে দিয়ে কাজের প্রতি উৎসাহিত করেছিলেন। ভিক্ষার টাকায় আর যাই হোক দেশ গড়া যায় না।
সাহায্যের নামে বিভিন্ন মাধ্যমে যে কোটি কোটি টাকা বহির্বিশ্ব থেকে আমাদের দেশে আসে তা পক্ষান্তরে আমদের জাতিকে পঙ্গু করে তুলছে। আত্মসম্মান বলে যে বিশেষ শক্তি মানুষের আছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে দান করাটা একটা ফ্যাশানে পরিনত হয়েছে। কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বিত্তবান ব্যক্তি সামান্য পরিমান সাহায্য করলেও তারা এটাকে বিভিন্ন ভাবে প্রচার করেন এবং এটা থেকে উপর্যপরি ফায়দা তুলে নেন। তাই প্রচলিত পন্থায় দান করলে ধনী-গরীবের পার্থক্যটাই স্পষ্ট হয় মাত্র, ব্যাবধান কমে না।