যশোর কারাগারে টাকায় মেলে মাদক-মোবাইল

জেমস আব্দুর রহিম রানা: যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে অনিয়মের অধ্যায় শুরু পিসি বই থেকে। টাকা দিলে জেলখানায় মাদক, মোবাইল তো হর হামেশা পাওয়া যায়। টাকাওয়ালারা ঘরের ন্যায় জেলখানাতে বসবাস করেন আরাম-আয়েশে। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনার কথা কেউ প্রকাশ করেন না। কারণ বেশির ভাগ হাজতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা অপরাধী হওয়ায় তাদের বারবার যেতে হয় কারাগারে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, যশোরে একজন হাজতি জেলখানার গেটে প্রবেশের পর থেকেই টাকা আদায়ের সূচনা করে কারাকর্তৃপক্ষ। যা চলে জামিনে বের হওয়ায় পর্যন্ত। মাদক, মোবাইল, নামের বানান ভুল, চিকিৎসা, খাবারসহ বিভিন্ন খাতে এ টাকা আদায় করা হয়। জেলখানায় টাকা আদায়ের কাজ করে থাকেন আসামি, জেল পুলিশ, ক্যান্টিনে কর্মরতরা।

সম্প্রতি যশোর কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন আক্তারুজ্জামান। তিনি জেলার বাঘারপাড়া এলাকার একটি নাশকতা মামলার আসামি। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, কারাগারে প্রবেশের আগে হাজতিকে তাদের নাম, বাবার নাম ও বাড়ির ঠিকানা লিখতে হয়। হাজতিরা তাদের নাম ও পরিচয় সঠিক দিলেও কারাকর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে ভুল লেখে। একজন হাজতির নাম যদি হয় ‘আব্দুর রহমান’ কারাকর্তৃপক্ষ তার নাম লিখবে ‘আব্দুর বহমান’। আদালত থেকে তার জামিন মঞ্জুর হলেও ‘র’ ও ‘ব’ এর বেড়াজালে আটকে দেওয়া হয় ওই হাজতিকে। গেটের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীকে টাকা দিলে ‘ব’ আবার ‘র’ হয়ে যায়। কেউ টাকা দিতে না পারলে তাকে অতিরিক্ত একদিন হাজতে থাকতে হয়। তবে এ টাকা হাজতিকে দিতে হয় পিসি বইয়ের মাধ্যমে।’

তিনি আরও বলেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে পিসি বইয়ের দায়িত্বে রয়েছেন শাহনেওয়াজ। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় অপরাধের দায়ে ১০ বছরের জেল হয়েছে তার। হাজতিদের স্বজনরা এসে পিসি বইতে টাকা জমা দেন। কিন্তু শাহনেওয়াজ পিসিতে টাকা জমা না দিয়ে আমার মতো অনেক হাজতির টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আমার বড় ভাই পিসি বইতে ১৫শ’ টাকা জমা দেন। কিন্তু শাহনেওয়াজ সেই টাকা আত্মসাৎ করেন।

মার্ডার মামলায় ভোলার চরফ্যাশনের একজন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। এ আসামির মা আয়েশা বলেন, কারাগারে প্রবেশের প্রথম দিন আমদানিতে রাখা হয় ছেলেকে। পিসি বইয়ের মাধ্যমে আমদানিতে বেড পেতে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। পরের দিন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানেও টাকা গুনতে হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলেও টাকা দিতে হয়। কয়েক দিন আগে ছেলে অসুস্থ ছিল। কারাগারের মেডিকেলে সিট পেতে টাকা দিতে হয়েছে। আমার ছেলে ভর্তির দিন ৬৫ সিটের বিপরিতে রোগী ছিল ৪০/৪৫জনের মতো। কিন্তু সিট পেতে পিসি বইতে ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে। তারপর সিট পেয়েছে ছেলে।

নাম না প্রকাশের শর্তে এক কারা কর্মকর্তা বলেন, কারাগারের অভ্যন্তরে ফেন্সিডিল, ইয়াবা ট্যাবলেট, গাঁজা বিক্রি হয়। যেহেতু কারাগারে বেশিরভাগ মাদক কারবারিকে পাঠানো হয়। তারা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারাগারে মাদক নিয়ে আসে এবং বিক্রিও করেন। প্রায় প্রতিদিন এক-দুইজন করে ধরাও পরে। এছাড়াও দায়িত্বরত আমাদের অনেক লোক অর্থের বিনিময়ে মোবাইল ব্যবহারে সাহায্য করে থাকেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, অনেক হাজতি কারাগারে আসার সময় শরীরে বিশেষ কায়দায় ইয়াবা বা গাজা নিয়ে আসে। তাদের বিশেষভাবে শরীর চেক করার পরে ধরা পড়েন। আবার অনেক হাজতি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব মাদক এনে থাকছেন। কারাকর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে খুবইকঠোর হলেও সিন্ডিকেটের কাছে তারা হেরে যাচ্ছেন।’

তিনজন জামিন প্রাপ্ত আসামি বলেন, কারাগারে ভাতে পোকা, ঘাস-পাতা পাওয়া যায়। একই সাথে ২৫ গ্রাম ওজনের মাস-মাংস দেয়। কারাগারে খাবার খুবই নিম্ন মানের। বন্দিদের উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করার কথা থাকলেও কারা কর্তৃপক্ষ সেটা করেন না। তবে টাকার বিনিময়ে ক্যান্টিন থেকে চড়া মূল্যে মাছ ও মাংস কিনে খেতে পারেন বন্দিরা। তাই যাদের সামর্থ আছে তারাই কারাগারে বসে ভালমন্দ কিনে খেতে পারেন।

তারা আরও বলেন, কারাগারের অভ্যান্তরে নগদ টাকা বহন করা বড় ধরনের অপরাধ। তাই বাইরে থেকে কেউ টাকা দিতে চাইলে ব্যাংক হিসেবের মতো পিসি বইতে টাকা জমা হয়। কারো টাকার প্রয়োজন হলে পিসি বইয়ের মাধ্যমে ক্যান্টিন থেকে লেনদেন করেন। আর এখানেই হলো আসল দুর্নীতি। কেউ একশ টাকা চাইলে তাকে দেওয়া হয় ৯০ টাকা। বাকি ১০টা কমিশন বাবদ কেটে রাখা হয়।’

এ বিষয়ে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে সিনিয়ার জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) সুরাইয়া আক্তার বলেন, প্রতিদিন মাদক মালমার আসামিরা কারাগারে আসেন আবার জামিন নিয়ে বের হচ্ছেন অনেকে। আমরা প্রত্যেক ওয়ার্ডে নিয়মিত চেক করি । তাতে কেউ না কেউ মাদকসহ ধরা পড়েন। সেগুলো নষ্ট করা হয়। মাদক কারবারিদের কঠোর শাস্তিও দেওয়া হয়। তারপরও থামছে না এ অপকর্ম। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহে এক দিন মোবাইলে কথা বলতে দেওয়া হয়। এরমধ্যে অনেকে নিয়ম ভঙ্গ করে অসদুপায়ে মোবাইলে কথা বলেন। ধরতে পারলে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, চিকিৎসা, খাবারে মান, পিসির টাকা আত্মসাৎ অভিযোগের বিষয়গুলো সঠিক নয়। কারা কর্তৃপক্ষ টাকার বিনিময়ে কোনো কাজ করে না। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চলে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার। তাছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাওয়া হয়। তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে চাওয়া হয়। তখন কোনো আসামি অভিযোগ করেন না। তাহলে সমস্যার সমাধান করবো কি ভাবে।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

বিএনপির ব্যানার নিয়ে মানববন্ধনে আ.লীগের নেতাকর্মীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: মাদারীপুরের কালকিনিতে বিএনপির ব্যানারে অনুষ্ঠিত এক মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমনকি যারা মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন তারা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের

‘চট্রগ্রামে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট’

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম মহানগরীতে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ খাচ্ছে লবণ পানি। কারণ কাপ্তাই হ্রদ থেকে পানি ছাড়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। সেই

মেট্রোরেলের ওয়ার্কশপে রহস্যময় ডাকাতি’

নিজস্ব প্রতিবেদক: মেট্রোরেলের কাজে নিয়োজিত চায়না সিনো হাইড্রো কোম্পানির ওয়ার্কশপে হানা দেয় একদল ডাকাত। মঙ্গলবার (২ মার্চ) সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টা। মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়কের বোট

স্বপ্নদোষ হলে কি রোজা ভেঙে যায়?

ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: রোজা থাকা অবস্থায় দুপুরে ঘুমানো নিষেধ নয়। এমনকি ঘুমের ভেতরে স্বপ্নদোষ হলে স্বপ্নদোষের কারণেও রোজা ভাঙে না। তবে স্বপ্নদোষের কারণে গোসল

অর্থের অভাবে মিলছে না উন্নত চিকিৎসা শুকিয়ে কংকালসার শিশু আবু তালহা

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে আড়াই বছর বয়সের আবু তালহা নামের এক শিশু অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা না পেয়ে শুকিয়ে কংকালসার হয়ে গেছে। আবার চিকিৎসকগণও নির্ণয়

ইরানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, বহু হতাহতের আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ইরানের একটি বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। শনিবার (২৬ এপ্রিল) দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী বন্দর আব্বাসে এ বিস্ফোরণ ঘটে। বার্তাসংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য