জেমস আব্দুর রহিম রানা: প্রায় দুই হাজার বছর আগের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান মিলেছে যশোরের মনিরামপুরের ‘ধনপোতা’ ঢিবিতে। এই মন্দির সনাতন ধর্মাবলী অথবা বৌদ্ধ ধর্মাবলীদের হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু নিয়ে গবেষণার পর পুরো রহস্য উন্মোচিত হবে। গণমাধ্যম কর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব দাবি করেন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন।
এদিকে ধনপোতা ঢিবিতে খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর উন্মুক্ত প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন স্থানীয় এমপি ইয়াকুব আলী। এতে প্রায় দুই হাজার বছর আগের পোড়া মাটির টেরাকোঠা বল, চুন রাখার পাত্র, কাচের চুরি, লৌহ জাতীয় শলাকা, নকশাকৃত ইটের সন্ধান মিলেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন আরও জানান, প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর সঙ্গে মনিরামপুর উপজেলার দমদম পীরের ঢিবি পার্শ্ববর্তী কেশবপুরের ভরত ভায়না, ডালিঝিরা ঢিবি, খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনি প্রত্নস্থানের মিল রয়েছে বলেও দাবি করেন।
ধনপোতা ঢিবি সংলগ্ন স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ ছলেমান বলেন, তিনি বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনে আসছেন এখানে বিরাট রাজার বাড়ি ছিল। পাশাপাশি আরও দুইটি ঢিবি রয়েছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, স্বরূপ নদীর পাড়ে ধনপতি সওদাগার নামে এক প্রভাবশালীর বাড়ি ছিল। আবার অনেকেই মনে করেন এই ঢিবিগুলো প্রাগৈতিহাসিকযুগে প্রতাপশালী বিরাট রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। মহাভারতের বিরাট অংশের কাহিনীতে পঞ্চপাণ্ডব যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব এবং তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদীকে নিয়ে এই বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। শকুনি মামা গান্ধার রাজের চক্রান্তে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার শর্তানুযায়ী পঞ্চপাণ্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদীকে নিয়ে ১২ বছর বনবাসে ছিলেন। তারা স্বরূপ নদীর তীরে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মহাভারতের বিরাট কাহিনীর অংশের সঙ্গে এটির মিল পাওয়া যায়।
স্থানীয় মনোরঞ্জন বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি বলেন, তার ঠাকুর দাদা কুঞ্জবিহারী বিশ্বাস এক সময় অসুস্থ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। তাকে ঝোলায় করে কলকাতায় চিকিৎসা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগ নিরাময় না হওয়ায় তাকে বাড়িতে ফেরত আনা হয়। এক রাতে তাকে স্বপ্ন দেখানো হয়, বাড়ির পাশে এক বাগানে প্রাচীন বৃক্ষের নিচে রেখে আসার কথা বলা হয়। তারা স্বপ্ন অনুযায়ী ওই বৃক্ষের নিচে রেখে আসেন। তখন ওই বাগানে বন্যশূকর, বাঘসহ নানা হিংস্র পশুর বাস ছিল। কিছু দিনের মধ্যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। পরে সুস্থ হয়েও তিনি ওই বৃক্ষের নিচে বসবাস করতে থাকেন এবং ধ্যান করতেন।
এই বৃক্ষের গোড়ার অংশ এখনো ধনপোতা ঢিবির পশ্চিমে খেদাপাড়া বাজার সংলগ্ন বৈদ্যনাথ ধামে ওই বৃক্ষের গোড়ার অংশ রয়েছে। মহাভারতে শিব আশ্রিত যে গাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সঙ্গে এই প্রাচীন বৃক্ষের অবশিষ্টাংশের মিল খুঁজে পান স্থানীয় অনেকেই। বর্তমানে এই বৈদ্যনাথ ধামের এই প্রাচীন বৃক্ষের গোড়ার অংশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনা করে থাকেন।
এছাড়া ধনপোতা ঢিবির পাশের বিল খুঁড়লেই প্রাচীন নৌকার অংশ বিশেষসহ নানা ধরনের জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায়। এতে স্থানীয়রা মনে করেন এই বিল এক সময় নদী ছিল, যা মহাভারতে উল্লেখিত স্বরূপ নদী বলে মনে করা হয়। এই নদী এক প্রবহমান ছিল। আর এই নদীর তীরে ছিল বিরাট রাজার বাড়ি। যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন পঞ্চপাণ্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদী।
উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ গত ১০ ডিসেম্বর হতে এই ধনপোতা ঢিবি খোঁড়া শুরু করে, যা ৩০ জানুয়ারি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে আবারো খোঁড়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।