জেমস আব্দুর রহিম রানা: যশোরসহ সারাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে উদ্বেগজনকভাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। দুই বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার আগেই ঝরে পড়েছে পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ শিক্ষার্থী। যার মধ্যে যশোর বোর্ডে ঝরে পড়েছে ৪৪ হাজার ৫২২ জন। ঝরে পড়ার হারে এগিয়ে রয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা। গত দুই বছরে দুই লাখ ৮২ হাজার ২৯৬ জন মেয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষার মূলস্রোত থেকে হারিয়ে গেছে। এ স্তরের মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া, শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অনেকে ঝরে পড়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সচেতন মহল।
শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার প্রতি বছর উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই, খাবার দেয়াসহ অন্যান্য খাতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। এরপরও বিভিন্ন পর্যায়ে এতো অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী কেনো ঝরে পড়ছে এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি শেষ করে ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিলো ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী। ২০২৪ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) বসার কথা ছিলো তাদের। কিন্তু চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসছে ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায়ে দুই বছরে পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৩.৮০ শতাংশ। যার মধ্যে যশোর বোর্ডে ঝরে পড়েছে ৪৪ হাজার ৫২২ জন। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে একযোগে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হবে।
মাত্র দুই বছরে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ নিশ্চিত করা গেলেও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এ জায়গায় সরকারকে আরো বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালে জেএসসি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে নবম শ্রেণিতে (২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ) রেজিস্ট্রেশন করেছিলো ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে এবার এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। অর্থাৎ নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেও এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য ফরম পূরণ করেনি পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছাত্রী আট লাখ ৯১ হাজার ৭২১ জন এবং ছাত্র আট লাখ ১৮ হাজার ৫৭৫ জন। অর্থাৎ তারা শিক্ষার মূলস্রোত থেকে হারিয়ে গেছে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ২৯ হাজার ৭৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। তাদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। অনিয়মিত পরীক্ষার্থী তিন লাখ ১১ হাজার ৫১৩ জন।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, করোনার ধাক্কায় দেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে সব স্তরের শিক্ষায় প্রতি বছর ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঝরে পড়ার প্রকৃত তথ্য নিরূপণ করা জরুরি। সেজন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
তারা বলছেন, সমাজের অতিদরিদ্র ব্যক্তিটিও চান তার সন্তান লেখাপড়া করুক। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে দেশে যে ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, নোট-গাইড আর প্রাইভেট-কোচিংয়ের যে দৌরাত্ম্য চলছে, কম আয়ের পরিবারগুলো এ ধাক্কা সামলাতে পারছে না বলেই ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া এ স্তরের মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া, শিক্ষার সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অনেকে ঝরে পড়েছে।
সূত্রমতে, ঝরে পড়ার হারে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে মাধ্যমিক পর্যায়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিলো ১১ লাখ ৭৪ হাজার ১৭ মেয়ে। এসএসসির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছে আট লাখ ৯১ হাজার ৭২১ জন। অর্থাৎ ঝরে পড়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ২৯৬ জন। অন্যদিকে, নবম শ্রেণিতে ছেলেরা রেজিস্ট্রেশন করেছিলো ১০ লাখ ৭০ হাজার ৭১৬ জন। তাদের মধ্যে এসএসসিতে ফরম পূরণ করেছে আট লাখ ১৮ হাজার ৫৭৫ জন। ঝরে পড়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার ১৪১ জন। ছেলেদের তুলনায় মেয়ে ৩০ হাজার ১৫৫ জন বেশি ঝরে পড়েছে।
যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোঃ আহসান হাবীব বলেন, বর্তামান সরকার কারিগরী শিক্ষার গুরুত্ব বেশি দেয়ায় অনেক শিক্ষার্থী জেনারেল শিক্ষা ছেড়ে কারিগরী শিক্ষার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যে কারণে জেনারেল শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এছাড়া বিগত দিনে করোনা মহামারীতে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কর্মসংস্থানের দিকে নিয়ে গেছে। ঝরে পড়ার এটিও একটি বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা থেকে শুরু করে দেশের সামগ্রীক ক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বড় ধরণের ভূমিকা রাখছে। যদিও গত বছরের চেয়ে চলতি বছর যশোর বোর্ডে ১২ শ’ মেয়ে শিক্ষার্থী বেড়েছে তারপরও সামগ্রিকভাবে দেশে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৪ পার্সেন্ট। মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। এ ছাড়া, শিক্ষার সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, কোন কোন ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অনেকে ঝরে পড়েছে।
নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এ বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেবেন জানিয়ে দৈনিক নাগরিক ভাবনাকে বলেন, ২০১০ এর শিক্ষানীতির আলোকে নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক অথবা স্বল্পমূল্যে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। কোনো শিক্ষার্থী যাতে নিম্ন মাধ্যমিক থেকে ঝরে না পড়ে, সেই প্রয়াস থাকবে।
তিনি বলেন, মাধ্যমিকে কেনো ঝরে পড়ছে, এটা মোটামুটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। তাই ঝরে পড়া রোধে আমি গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে চিন্তা করছি। নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা একেবারে বিনামূল্যে না হলেও স্বল্পমূল্যে যাতে পড়াশোনা করতে পারে সে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি ঝরে গেছে এমন শিশুদের কর্মমুখী একটি কোর্সের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থাকবে।
শিক্ষাবোর্ড সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের নিয়মিত পরীক্ষায় বসছে ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ শিক্ষার্থী। এছাড়া এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এক থেকে একাধিক বিষয়ে পরীক্ষা দেবে তিন লাখ ১১ হাজার ৫৩৩ পরীক্ষার্থী। ফলে নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে পরীক্ষায় বসবে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন।
অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের কেউ এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিলো বা কাঙ্ক্ষিত নম্বর না পাওয়ায় মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেবে। এর মধ্যে এক বিষয়ের পরীক্ষা দেবে সবচেয়ে বেশি এক লাখ ৯০ হাজার ৭৪৩ জন। দুই বিষয়ে পরীক্ষা দেবে ৫৯ হাজার ৫৪৫ জন। তিন বিষয়ের পরীক্ষা দেবে ১৯ হাজার ৩৩৫ জন, চার বিষয়ের পরীক্ষা দেবে পাঁচ হাজার ৬৫০ জন। নতুন করে সব বিষয়ে পরীক্ষা দেবে ৩৬ হাজার ২৬০ জন।
বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংখ্যাগত হিসাবে ঝরে পড়ার হারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সবচেয়ে এগিয়ে। ২০২২ সালে এ বোর্ডে চার লাখ ৩৫ হাজার ৬২৬ জন নিবন্ধন করলেও পরীক্ষা দিচ্ছে তিন লাখ ৩৪ হাজার ৯২০ জন। ঝরে পড়েছে এক লাখ ৭০৬ জন। এভাবে রাজশাহী বোর্ডে ঝরে পড়েছে ৩৫ হাজার ২৯১ জন, কুমিল্লা বোর্ডে ৫৪ হাজার আটজন, যশোর বোর্ডে ৪৪ হাজার ৫২২ জন, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৩৫ হাজার ১৩৭ জন, বরিশাল বোর্ডে ১০ হাজার ১২৫ জন, সিলেট বোর্ডে ২৭ হাজার ২০১ জন, দিনাজপুর বোর্ডে ২৭ হাজার ৪৯২ জন, ময়মনসিংহ বোর্ডে ১৬ হাজার ৫৭৩ জন ঝরে পড়েছে। মাদরাসা বোর্ডে তিন লাখ ৫১ হাজার ৪০৮ জন নিবন্ধন করলেও পরীক্ষা দিচ্ছে দুই লাখ ৩২ হাজার ২৪৯ জন। টেকনিক্যাল বোর্ডে এক লাখ ৭৭ হাজার ১৭৯ জন নিবন্ধন করলেও পরীক্ষা দিচ্ছে এক লাখ ১২ হাজার ৯৫৬ জন।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। গত বছর পরীক্ষা দিয়েছিল ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন। সে হিসেবে এবার পরীক্ষার্থী কমেছে ৪৭ হাজার ৯৭১ জন। তবে পরীক্ষা কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। গত বছরের তুলনায় এবার পরীক্ষা কেন্দ্র কমেছে ১৮০টি এবং পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৬৩টি।
সাধারণ ৯ শিক্ষা বোর্ডে তত্ত্বীয় পরীক্ষা ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা ১৩ মার্চ শুরু হয়ে ২০ মার্চ শেষ হবে। আর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের তত্ত্বীয় পরীক্ষা ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা ১৬ মার্চ শুরু হয়ে ২১ মার্চ শেষ হবে। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তত্ত্বীয় পরীক্ষা ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। ব্যবহারিক পরীক্ষা ১৩ মার্চ শুরু হয়ে ২১ মার্চ শেষ হবে।
এবছর দেশের বাইরের ৮ কেন্দ্রে মোট ৩৫২ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। বিদেশের ৮টি কেন্দ্র হলো- সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রিয়াদের বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি স্কুল, ত্রিপোলির বাংলাদেশ কমিউনিটি স্কুল, কাতারের দোহায় বাংলাদেশ মাসহুর-উল-হক মেমোরিয়াল হাই স্কুল, দুবাইয়ের শেখ খালিফা বিন জায়েদ বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল, বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুল, মানামার বাহরাইনে বাংলাদেশ স্কুল ও ওমানের বাংলাদেশ স্কুল।