নিজস্ব প্রতিবেদক: মেট্রোরেলের কাজে নিয়োজিত চায়না সিনো হাইড্রো কোম্পানির ওয়ার্কশপে হানা দেয় একদল ডাকাত। মঙ্গলবার (২ মার্চ) সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টা। মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়কের বোট ক্লাবের উল্টোপাশে এমন ঘটনা ঘটে। প্রথমে নিরাপত্তারক্ষী ও পরে সেখানে অবস্থানরত শ্রমিকদের বেঁধে ফেলে তারা। এরপর প্রায় ৫ ঘণ্টা ধরে চলে লুটপাট। তবে এই দীর্ঘ সময়ে বাইরে থেকে ঘটনা টের পায়নি কেউ। রহস্যজনকভাবে ডাকাতির আগে খুলে ফেলা হয় ওয়ার্কশপের সিসিটিভি ক্যামেরা।
ডাকাতির এ ঘটনায় শুরুতে প্রথমে মামলা নিতে চায়নি পুলিশ। তুরাগ ও রূপনগর থানার ঠেলাঠেলিতে কেটে যায় এক দিন। এরপর বিষয়টি গড়ায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার পর্যন্ত। তিনি ম্যাপ দেখে রূপনগর থানাকে মামলা নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন। এতে ঘটনার এক দিন পর মামলা নেয় রূপনগর থানা পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেলের ওয়ার্কশপের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও টের পাননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গত বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিন ওই ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি বিরাজ করছে। ওই রাতে ঘটে যাওয়া ডাকাতির পর অনেকটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানালেন তারা।
সিনো হাইড্রোর এই কারখানায় এক বছর ধরে মেকানিকের কাজ করেন সীতাকুণ্ডের মো. সাকিব। ডাকাতির বিষয়ে জানতে চাইলে তার হাত-পা কাঁপতে দেখা যায়। লোমহর্ষক সেই ডাকাতির দৃশ্য তিনি ভুলতে পারেননি।
সাকিব বলেন, ‘আমরা এক রুমে চারজন বসে ইফতার করছিলাম। এমন সময় ১০-১২ জন লোক এসে গলায় ছুরি ধরে। আমি ইফতার করার সময় ফোন টিপতে ছিলাম। এক ডাকাত আমাকে ধমক দিয়ে ফোন টেপা বন্ধ করতে বলে। এরপর আমাদের হাত বেঁধে পাশের একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের আরও তিন শ্রমিক ছিল। সবাইকে বেঁধে ফেলা হয়। আমাদের সবাইকে ঘরের মধ্যে জিম্মি অবস্থায় রাখা হয়। এরপর তারা প্রজেক্টের ভেতরে থাকা মালপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়।’
হাফিজুর রাসেল নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘ইফতারের সময় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে ডাকাত দল এসে আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলে। তারা সবাই সুঠাম দেহের অধিকারী এবং মুখে মাস্ক পরা ছিল। সব ডাকাত একজনকে স্যার স্যার বলে ডাকছিল।’
তবে শ্রমিকদের তথ্যমতে, ডাকাতির সময় সেখানে তারা মোট ১০ জন ছিলেন। এর মধ্যে একজন গেটে নিরাপত্তার দায়িত্বে, দুজন ছিলেন নামাজে আর বাকি সাতজন ছিলেন দুটি রুমে। ডাকাত দল প্রথমে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে ওয়ার্কশপের ভেতরে ঢোকে। এরপর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রহরী এবং দুই রুমে থাকা সাতজনকে বেঁধে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর নামাজে যাওয়া দুজন ওয়ার্কশপে ঢুকলে তাদেরও বেঁধে ফেলা হয়। এরপর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় মালপত্র।’
ডাকাত দল সেদিন যাদের হাত-পা বেঁধে ডাকাতি করে তারা হলেন চান মোহন সরকার, মো. সাকিব, বিপ্লব হাওলাদার, মো. হাফিজুর রাসেল, সাকিব ওরফে শাহরিয়ার, মুরাদ ড্রাইভার, মুজাফির, মাযুদ, আমিনুল এবং হাবিল সরদার।
থানায় দেওয়া লিখিত অভিযোগ অনুযায়ী ডাকাতি হওয়া মালপত্রের মধ্যে রয়েছে এক লাখ আশি হাজার টাকা মূল্যের ১৮টি ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারি, ৪ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ও ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ, প্রায় ১২ লাখ টাকা মূল্যের দুই ধরনের কপার স্ট্যান্ডার্ড ওয়াব ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫৯২ পিস মিডিল ক্লাম (সাইজ ৬০ মিমি), ১ লাখ ৪৬ হাজার টাকার ৫ হাজার ৭৬০টি ইনডক্লাম, ৪ হাজার ৩৯৮ টাকার ১ হাজার ৬১৬ পিস বোল্ট, ২০ হাজার টাকা মূল্যের একটি ব্যাটারি চার্জার, ৩৫ হাজার টাকার ওয়েল্ডিং মেশিন এবং কর্মচারীদের কাছে থাকা নগদ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ২১ লাখ ৫২ হাজার টাকার মালপত্র নিয়ে গেছে ডাকাতরা।
এ ঘটনায় গত বুধবার রাজধানীর রূপনগর থানায় সিনো হাইড্রোর পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. মাসুদকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে মামলা করেন মিস্ত্রি মো. মনজু মিয়া।
মামলার এজাহারে মো. মনজু মিয়া বলেছেন, ‘গত ২ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ৮ থেকে ১০ জন ডাকাত ছুরি, চাপাতি, দেশি অস্ত্রসহ ওয়ার্কশপে ঢুকে পড়ে। তারা গেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা চান মোহনকে হাত-পা বেঁধে সবাইকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এ সময় সবার কাছে থাকা আনুমানিক ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। ডাকাতরা সবাই বরিশাল এবং ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তারা সবাই লম্বা প্রকৃতির, একজন মোটা এবং অন্যরা ৫ ফুট ৬ থেকে ১০ ইঞ্জির মতো লম্বা। ডাকাতদের মধ্যে দীর্ঘকায় দেহের ডাকাতকে সবাই ‘স্যার, স্যার’ ডাকে এবং আমাদের বলে, আমরা থানা থেকে এসেছি।
আমাদের কাজ করতে দাও। তার পরনে হালকা হলুদ রঙের হাফহাতা গেঞ্জি পরা ছিল। বাকিরা শার্ট, গেঞ্জি, প্যান্ট এবং একজন লুঙ্গি পরিহিত ছিল। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওয়ার্কশপের ভেতরে একটি গাড়ি ঢোকার শব্দ শুনতে পান শ্রমিকরা। এর কিছুক্ষণ পরপর ওয়ার্কশপের ভেতরে কিছু ভাঙার এবং গাড়িতে মালপত্র তোলার শব্দ শুনতে পান। এভাবে ডাকাতরা রাত ১১.১৭ মিনিট পর্যন্ত ওয়ার্কশপের ভেতরে ডাকাতি করে চলে যায়। চলে যাওয়ার সময় সব শ্রমিককে একটি কক্ষে আটকে দরজার সিটিকিনি বাইরে দিয়ে আটকে রেখে যায়। এ সময় তারা শ্রমিকদের বলে যায়, আমরা চলে যাচ্ছি, তোদের সবার মোবাইল ফোন একটি রুমের ভেতরে আছে, আমরা তোদের মোবাইল নেব না, নিলে ধরা খেয়ে যাব।’
মামলার এজাহারে মনজু মিয়া আরও উল্লেখ করেছেন, ‘ডাকাতরা চলে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে, আমরা মুখ দিয়ে একে অন্যের বাঁধন খুলি এবং রুমের সিলিং দিয়ে অন্যরুমে গিয়ে আমাদের দরজার বাইরে দিয়ে লাগানো সিটকিনি খুলে সবাই বাইরে বের হয়ে আসি। এরপর একটি রুমের ঝুড়ির ভেতর আমাদের সবার মোবাইল দেখতে পাই।’
ঘটনা জানতে চাইলে মামলার বাদী মনজু মিয়া বলেন, ‘ইফতারের টাইমে ৮ থেকে ১০ জন লোক এসে প্রথমে সিকিউরিটি গার্ডরে বাইন্দালায়। এরপর আমাদের বাইন্দা তারা ডাকাতি কইরা চইলা যায়। আমরা রূপনগর থানায় মামলা করেছি। পুলিশ এরপর আর কিছু জানায় নাই। আইজ মিন্টো রোডের ডিবি অফিস থেকে আমাগো ডাকছিল, ওইহানে সব লেইখা নিছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডাকাতির পর ওই রাতেই কর্তৃপক্ষ মামলা করতে থানায় যায়। তবে প্রাথমিকভাবে থানা মামলা নেয়নি। তুরাগ এবং রূপনগর থানার ঠেলাঠেলিতে ওই রাত কেটে যায়। রূপনগর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘আসলে ওই এলাকাটি তুরাগ থানার আন্ডারে। ওখানে তুরাগ থানাই সব দেখাশোনা করে। যে কারণে আমাদের থানা প্রথমে মামলা নেয়নি। এরপর বিষয়টি কমিশনার স্যারের কাছে গেলে স্যার ম্যাপ দেখে আমাদের মামলা নিতে বলেন। এরপর রূপনগর থানায় মামলা নথিভুক্ত হয়।’
জানতে চাইলে রূপনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলা করা হয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা একটি ভালো ফলাফল পাব।’
কাউকে শনাক্ত করা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তদন্তের স্বার্থে আমরা এখন বিস্তারিত বলতে পারছি না। আশা করছি, শিগগির আমরা একটি ফলাফলে পৌঁছাতে পারব। এরপর বিস্তারিত জানাব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি’) জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘গত বুধবার আমি নিজে ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছি। এ নিয়ে থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমার কাছে এ মুহূর্তে এর বেশি তথ্য নেই।’
এদিকে ওয়ার্কশপে ডাকাতির বিষয়ে কিছুই জানে না মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সচিব আব্দুর রউফ কালবেলাকে বলেন, ‘রূপনগর থানা এলাকায় আমাদের আলাদা কোনো ওয়ার্কশপ নেই। কোম্পানির ওয়ার্কশপ মেট্রোরেল কম্পাউন্ডের মধ্যেই। ডাকাতির বিষয়ে আমরা অবগত নই। এটা ঠিকাদারদের ওয়ার্কশপ হতে পারে।’