নিজস্ব প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল থেকে সরে আসতে পারে বলে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মনে করছে। তার বদলে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরও কাছে পেতে চায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই দেশটি। সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ এবং বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় হ্রাসের প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে পরিবর্তিত নীতি গ্রহণ করছে বলে একাধিক সূত্র মনে করছে।
গত দুই বছর আগে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল অনেকটাই নেতিবাচক এবং আগ্রাসী। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরব ছিল। বিশেষ করে বিগত নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ওপর এক সরাসরি চাপ প্রয়োগ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত নির্বাচনের আগে এক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয় সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা সহ নানা রকম কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করারও হুমকি দিচ্ছিল।
নির্বাচনের আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। কিন্তু ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকেই আস্তে আস্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাল্টাতে থাকে। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর বিএনপির তাণ্ডব সহিংসতার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি পরিবর্তিত এবং ভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে।’
তবে কূটনৈতিক মহল মনে করছে, নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে যে কৌশল পরিবর্তন করেছে তা বৈশ্বিক রাজনীতির একটি অংশ। এই সময় বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুর কারণে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিপত্তি এখন হুমকির মুখে। তা ছাড়া উপমহাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস হয়ে যাচ্ছে। চীনের আধিপত্য বাড়ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৈরী রাখা ইতিবাচক হবে না বলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে। আর এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ নীতি তাদের পরিবর্তন হচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেক কূটনীতিক বিশ্লেষকরা।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন যে, ভারতের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পাল্টেছে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও কথা বলেছিলেন মার্কিন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন সঙ্গে জয়শঙ্করের একাধিক বৈঠকের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে তার অবস্থান বদলেছে তাদের নিজেদের ইচ্ছায়, কারো চাপে বা প্রভাবে নয় এটি মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ রকম দেশ নয় যে, ভারতের কথায় একটি কূটনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সুস্পষ্ট কতগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন মার্কিন প্রভাব বলয় আলগা হতে শুরু করেছে। সৌদি আরব এখন চীনের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে চাচ্ছে। মার্কিন প্রভাব সৌদি আরবের ওপর কমে গেছে। সৌদি আরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং সৌদি আরবের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্ত অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্পর্ক আলগা হতে শুরু করেছে।’
ইসরায়েল ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মাঝে মাঝে অসহায় মনে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো আর সবকিছু করছে না। আর এর ফলে মুসলিম বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আস্থার সঙ্কটে ভুগছে। আর বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তর মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থাকাটা দরকার। তাছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশের পৃথক অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। এখন এই যুদ্ধ ইউক্রেন কেবল বিপযর্য নয়, পুরো ইউরোপই হুমকির মুখে। সবকিছু মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করছেন কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে যদি সম্পর্কের অবনতি ঘটে তাহলে এই অঞ্চলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ঘরে হয়ে পড়বে। সেই অবস্থা তারা চাইছে না। আর এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতি বদলে গেছে।’