আপনার জানার ও বিনোদনের ঠিকানা

পাকিস্তানের মূল ক্ষমতার ছড়ি সেনাবাহিনীর হাতেই

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর ৭৫ বছরের ইতিহাসে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সরাসরি দেশ শাসন করেছে সেনাবাহিনী। যখন বেসামরিক সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় এসেছে, তখনও পর্দার আড়ালে থেকে কেন্দ্রের বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করেছে তারা। এক কথায়, সেনাবাহিনীই সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তারা যখন খুশি দেশের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। নানা চাপে ও কারণে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কে ক্ষমতায় থাকবে আর কে থাকবে না-সেটাও ঠিক করছে সেনাবাহিনী। এটা করতে গিয়ে সে কখনও কারও শত্রু আবার কখনও মিত্র হয়ে উঠছে।

সাধারণত দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আপৎকালে জনগণের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়াই সেনাবাহিনীর কাজ। কিন্তু পাকিস্তানের বেলায় বিষয়টা যেন একটু আলাদা। দেশের নিরাপত্তার বিষয় দেখভালের পাশাপাশি ঈগলের মতো রাজনীতির ওপর নজর রাখাটাও তাদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠেছে।

পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিশ্চিতভাবেই অনেক শক্তিশালী। রাজনীতিকরা তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দেবেন, এটা তারা কোনোভাবেই মানতে পারে না বা মানতে চায় না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানে রাজনীতিকদের ক্ষমতা খর্ব করতে সরাসরি ভূমিকা পালন করে দেশটির সেনাবাহিনী। এজন্য তারা এমন রাজনীতিকদের পছন্দ করে, যারা সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করবে না বা তাদের স্বার্থ সমুন্নত রাখবে এবং পুতুলের মতো যেমন খুশি নাচতে পারবে। আর এ কারণেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। একটু উনিশ-বিশ কিংবা পান থেকে চুন খসলেই ক্ষমতা থেকে বিদায়!

বিশ্বের বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশের মতো পাকিস্তানে পাঁচ বছর পর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে কারও বন্ধু, আবার কারও শত্রুর ভূমিকায় দেখা গেছে। যেমনটা বলছেন কানাডার থম্পসন রিভারস ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সায়রা বানু।

এ অধ্যাপকের মতে, ২০১৩ সালের পর সেনাবাহিনীর এ ছক আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই বছর সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কিন্তু এরপর আস্তে আস্তে সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়ে উঠেন। কারণ তিনি সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রণয়ন করার চেষ্টা করেছিলেন। যার ফলে কয়েক বছর পর ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয় তাকে।

নওয়াজ শরিফের বিষয়টা এটাই প্রমাণ করেছে যে, পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এবং তারা তাদের কায়েমি স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে এমন একটি নীতিও তারা রাজনীতিকদের এগিয়ে নিতে দেবে না।

সায়রা বানু এক নিবন্ধে লেখেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর যে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দা-কুমড়া সম্পর্ক, সেই দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে সচেষ্ট হন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু দেশের ভেতরে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে নয়াদিল্লির সাথে উত্তেজনা বজায় রাখার প্রয়োজনে নওয়াজের সেই চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেনাবাহিনী।

২০১৪ সালে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের নিমন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফ ভারতের সঙ্গে এক ধরনের সংহতি প্রকাশ করেন। এরপর ২০১৫ সালে নওয়াজ শরিফের জন্মদিনে হঠাৎ লাহোরে নেমে সবাইকে চমকে দেন নরেন্দ্র মোদি।

এর মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হলেও ‘বন্ধু’ থেকে কয়েক বছরে সেনাবাহিনীর ‘শত্রু’ বনে যান নওয়াজ। এরপর ২০১৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট তাকে ‘আজীবন রাজনীতিতে নিষিদ্ধ’ করেন। নওয়াজের বিকল্প ময়দানে নামানো হয় বিশ্বকাপজয়ী তারকা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান খান।

সায়রা বানুর মতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী ইমরান খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) সমর্থন দিয়েছিল। আর তাই বছরের পর বছর রাজনীতিতে ব্রাত্য থাকলেও সেনার সমর্থনের হাওয়ায় ক্যাপ্টেনের জয়ের নৌকা বন্দরে পৌঁছে যায়।

পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাবেদ বাজওয়াও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে বিদায়ী সংবর্ধনায় তিনি প্রকাশ্যে বলেন, নওয়াজ শরিফের পর ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী করার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ক্ষমতায় আরোহণের পর এক পর্যায়ে পাক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেনস এজেন্সি (আইএসআই)-এর প্রধান নির্বাচন নিয়ে মতপার্থক্য থেকে খান ও সেনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব’ থেকে ‘শত্রুতা’ শুরু হয়। উত্তেজনা চরমে ওঠে।

অবশেষে মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে খানকে উৎখাত করা হয়।

কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরান খান চুপ করে থাকেননি। তিনি খোলাখুলি সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেছেন। যা আসিম মুনিরের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর পছন্দ হয়নি। যার প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনী তাকে আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার ব্যবস্থা নিয়েছে।

তার বিরুদ্ধে প্রায় দেড়শ মামলা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, একাধিক দুর্নীতির মামলায় তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সবশেষ তাকে এক মামলায় ১০ বছর, আরেক মামলায় ১৪ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, সেনাবাহিনীই নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিল করে আসন্ন নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ পরিষ্কার করেছে এবং তাকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে পছন্দের প্রার্থী হিসেবে তৈরি করছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার ইমরান খানকে সরিয়ে নওয়াজ শরিফকে সামনে আনা, যাতে তিনি ভবিষ্যতে সেনাস্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে বিরত থাকেন।

এরপরও ইমরান খান ও তার দল পিটিআই এ মুহূর্তে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। কিন্তু দলটি যাতে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে তার সব ব্যবস্থাই করা হয়েছে।

নির্বাচন সামনে করে কয়েক মাস আগে থেকে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর ব্যাপক ও নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালানো হচ্ছে। পিটিআই র সদস্যদের বিরোধী দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। দলের নির্বাচনী প্রতীক ‘ব্যাট’ কেড়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান, অনলাইন সমাবেশ ও তহবিল সংগ্রহে বাধা দেয়া হয়েছে। পিটিআই প্রকাশ্যেই অভিযোগ করছে, সামরিক বাহিনী সক্রিয়ভাবে দলটিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা করছে।

তবে এমন হয়রানি ও দমনপীড়নের মধ্যেও পিটিআই’র রাজনীতিকরা ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি প্রার্থীদের হত্যাও করা হচ্ছে।

সবশেষ বুধবার (৩১ জানুয়ারি’) রিহান জেব খান নামে পিটিআই’র এক তরুণ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না বিশ্লেষকরা। অধ্যাপক সায়রা বানু বলছেন, পাকিস্তান বর্তমানে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। এসব সংকট সমাধানে পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। কিন্তু তা অধরাই থেকে যাবে, যতক্ষণ না সামরিক বাহিনী তার সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে থাকে এবং রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করে।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Pinterest
Telegram

এই খবরও একই রকমের

বিয়ের এক সপ্তাহ না যেতেই সোনাক্ষী অন্তঃসত্ত্বা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দিন কয়েক আগেই জহির ইকবালের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন বলিউড অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহা। এর মধ্য দিয়ে সাত বছরের সম্পর্কের শুভ পরিণয় ঘটে। অভিনেত্রীর

‘নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন শেখ হাসিনা’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে, আর তখন নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ

২০ কোটি করে টাকা পাচ্ছেন এমপিরা’

বাংলা পোর্টাল: জাতীয় সংসদের ৩০০ এমপি নিজ এলাকার উন্নয়নের জন্য ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পাবেন। এমপিদের সুপারিশ অনুযায়ী নতুন প্রকল্প সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে

বরিশালে টিউবওয়েলে উঠছে না পানি, চরম দুর্ভোগে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক: নগরের পর এবার বরিশালের আশপাশের গ্রামেও একে একে অকেজো হচ্ছে টিউবওয়েল। দীর্ঘসময় চাপার পরও এসব কলে উঠছে না পানি। গতকাল শনিবার (২০ এপ্রিল)

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ব্যারিস্টার সুমন, থানায় জিডি

নিজস্ব প্রতিবেদক: মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক ওরফে সুমন। শনিবার (২৯

কখনো ম্যাজিস্ট্রেট কখনো ডিজিএফআই এর মেজর পরিচয় দিতেন মুক্তা

মইনুল হক মৃধা, রাজবাড়ীঃ কখনো পরিচয় দিতেন হাইকোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট কখনো ডিজিএফআই এর মেজর। এই চক্রের মূলহোতা মুক্তা পারভিন (৩১) নামে এক প্রতারককে রাজবাড়ী শহরের অনুপম