নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা শাহজাহান ভূঁইয়া জল্লাদ হিসেবে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। গত বছর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। ৬৬ বছর বয়সী শাহজাহান ভূঁইয়া নতুন জীবন শুরু করেছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকায়। সেখানে একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। ২৩ বছর বয়সী এক তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সাথী আক্তার নামের ওই তরুণীকে বিয়ে করেন শাহজাহান। কিন্তু ৫৩ দিনের মাথায় তাঁর ঘর ছেড়ে যান সাথী। আদালতে শাহজাহানের বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলাও দিয়েছেন।
রোববার (৩১ মার্চ) পাল্টা ওই তরুণী এবং তার মায়ের বিরুদ্ধে প্রতারণার একটি মামলা করেছেন শাহজাহান। মামলায় তিনি বলেছেন, ওই তরুণী ও তাঁর মা বিয়ের ফাঁদে ফেলে তাঁর (শাহজাহান) কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তরুণীর মামা।
শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হত্যা ও অস্ত্র মামলায় তার ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকর ও অন্যান্য কারণে তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে ৩২ বছর করা হয়। কারাগারের নথি অনুসারে, ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির জন্য ১২ বছর এবং ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অপর একটি মামলায় ডাকাতি ও হত্যার জন্য ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর।
শাহজাহানের আইনজীবী ওসমান গনি বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর স্থানীয় একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে এলাকাছাড়া হন শাহজাহান। প্রায় তিন যুগ কারাভোগের পর গত বছর জুনে মুক্তি পান তিনি।
কারাগারের নথি অনুযায়ী, কারাবন্দী থাকাকালে শাহজাহান ভূঁইয়া ২৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী ও জেএমবির দুই জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করেছেন তিনি।
মামলার নথি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, গত বছরের ১৮ জুন কারামুক্তির পর শাহজাহান ভূঁইয়া ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে বসবাস শুরু করেন। এরপর সেখানে একটি চায়ের দোকান দেন। একদিন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কেরানীগঞ্জের কদমতলী থেকে কোনাখালায় যাচ্ছিলেন। তখন গাড়ির ভেতর তিনি একটি ভ্যানিটি ব্যাগ খুঁজে পান। পরে ব্যাগের ভেতর থাকা কাগজে লেখা ছিল একটি মুঠোফোন নম্বর। সেই নম্বরে ফোন করে শাহজাহান ভ্যানিটি ব্যাগের মালিককে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলেন। পরে ব্যাগের মালিক ২৩ বছরের এক তরুণী তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে হাজির হন। পরে তরুণীর মা শাহিনূর বেগমের সঙ্গে শাহজাহানের পরিচয় হয়। শাহজাহানের দাবি, মুঠোফোনে পরিচয়ের পর তরুণীর সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার কথা বলেন। একপর্যায়ে তরুণী ও তাঁর মা জুরাইন থেকে কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে চলে আসেন। শাহজাহান ভূঁইয়ার বাসায় রান্নার কাজ নেন তিনি। পরিচয়ের দেড় মাস পর ২১ ডিসেম্বর তরুণীর সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে শাহজাহানের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই মাসের মাথায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই তরুণী শাহজাহানের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে নালিশি মামলা করেন।
মামলায় তরুণী দাবি করেন, বিয়ের উপঢৌকন হিসেবে শাহজাহানকে এক লাখ টাকার মালামাল দেয় তাঁর পরিবার। পাশাপাশি নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বিয়ের কয়েক দিন পর তাঁদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন শাহজাহান ভূঁইয়া। একই সঙ্গে শাহজাহান তিন লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করেন তরুণী।
ঢাকার সিজেএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর জানান, শাহজাহানের বিরুদ্ধে করা মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম’) আদালত।
তবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ মামুন অর রশীদ বলেন, শাহজাহান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে তরুণীর দায়ের করা কোনো মামলার কাগজপত্র কিংবা আদালতের কোনো আদেশ হওয়ার তথ্য তাঁর জানা নেই।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজাহান ভূঁইয়া কাছে দাবি করেন, তরুণীকে শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো প্রকারের নির্যাতন তিনি করেননি। যৌতুক চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং ওই তরুণী প্রতারণা করে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
শাহাজাহন ভূঁইয়া আজ ওই তরুণী ও তাঁর মাসহ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেছেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেছেন, তরুণী ও তার মা বিয়ের আগে নানা কৌশলে তাঁর কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন। বিয়ের দিন একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে তরুণী তাঁর কাছ থেকে আরও ১০ লাখ টাকা নেন। শাহজাহান বলেন, কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। আর কারাগারে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া টাকাসহ মোট ১৮ লাখ টাকা তিনি সাহায্য হিসেবে পান। সেই টাকা দিয়েই তিনি এই বিয়ে করেছেন।’
তরুণীর সঙ্গে শাহজাহানের করা অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ রয়েছে, তরুণী ১০ লাখ টাকা শাহজাহানের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছেন। বিয়ে বলবৎ রাখতে অপারগ হলে তিনি ১০ লাখ টাকা শাহজাহানকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। অঙ্গীকারনামায় আরও উল্লেখ রয়েছে, বিয়ের চার মাসের মাথায় শাহজাহান তরুণীর নামে ২ শতাংশ জমি হেবা (দান) করবেন। স্ত্রী হিসেবে স্বামী শাহজাহানের আদেশ তরুণী মেনে চলবেন। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সম্পর্ক উন্নয়নসহ সব ধরনের কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। অঙ্গীকারনামায় তরুণী ও শাহজাহানের স্বাক্ষর রয়েছে।
মামলায় শাহজাহান দাবি করেন, বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রী ও শাশুড়ি তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করা শুরু করেন। বিয়ের ৫৩ দিনের মাথায় স্ত্রী তাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে যান। শাহজাহানের সঙ্গে সংসার করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। পরে শাহজাহান অঙ্গীকারনামার শর্ত অনুযায়ী স্ত্রীকে দেওয়া ১০ লাখ টাকা ফেরত চান। তখন তারা সেই টাকা দিতে অস্বীকার করেন। স্ত্রী, শাশুড়িসহ অন্যদের বিরুদ্ধে করা প্রতারণার মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে সাথী আক্তারের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে তাঁর মামা দীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুঠোফোনে শাহজাহানের সঙ্গে তাঁর ভাগনি সাথী আক্তারের পরিচয় হয়। এরপর নানা প্রলোভন দেখিয়ে তিনি সাথীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাঁর আচরণ ভালো ছিল না। ভয়ভীতি ও মারধরের কারণে সাথী শাহজাহানের বাসা থেকে চলে আসে।
দীন ইসলাম বলেন, ১০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো টাকা দেননি শাহজাহান ভূঁইয়া। কিন্তু অঙ্গীকারনামায় সাথীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল।’