‘গইলির ধারের ঘাস গত্তি খায় না’ বাঙালির আত্মান্ধত্ব সম্পর্কিত এ-ধরণের প্রবচনের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন পড়ে কি? চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজ অব্দি বাংলা সাহিত্যের বোল-বচনে এই একই বাক্য শব্দ বদলে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ আমাদের সামনে এসেছে। আর সেই আত্মখোয়া স্বভাবের বলি হয়েছে আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তথা অস্তিত্ব। ‘পরধন লোভে মত্ত’ হয়ে ‘প্রাণধন’ খুইয়েছি বিসৃত্মির সস্তা ধূলোয়। তবে চেষ্টা করলে এখনো অতীতের সাথে আপোষ করে অজানা ‘জাতিস্মর’-এর হাত ধরে খুঁজে পেতে পারি আমাদের সেই ‘মানিক-রতন’।
তেমনই এক ‘হারানো সুর’-এর সন্ধান মিলেছে যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার গঙ্গানন্দপুর গ্রামে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে অতি প্রাচীন এই গ্রামের নাম আগে শুনে থাকলেও, শুনিনি কবিয়াল অমেদ আলি সরদারের নাম। যার জন্ম আনু. ১৮৬৬ সালে : বাংলা ১২৭৩, মৃত্যু ১৯৪২ সালে : বাংলা ১৩৪৯। ৭৫ বছর আগে মৃত্যুবরণ করা এই কবিয়ালের একটি গান অথবা তার সম্পর্কে একটি বাক্যও কোথাও লিপিবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়নি। এমনকি তার সমসাময়িক কেউ আজ আর পৃথিবীতে নেই। সে-কারণে তার সম্পর্কে জানার চেষ্টাটা এক রকম ‘অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া’র মতো অনিশ্চিত কিংবা ‘আয়না ভারণ’ দিয়ে জিন হাজির করার মতো কঠিন। তবে একজন তুলারাশি আছেন যিনি স্মৃতিতে ‘বাটি চালান’ দিয়ে অমেদ আলি সরদারকে জীবিত করতে পারেন। তিনি কিতাব আলি মৃধা (জন্ম ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ, ১৬ ফাল্গুন, রবিবার)। জন্মতারিখ দেখে তার স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে খানিকটা আঁচ করতে পারছেন বলে মনে করছি। তবে জেনে অবাক হবেন, ৮৮ বছরের এই বৃদ্ধ ইমাম সাহেব একাধারে অমেদ আলি সরদারের ৬০টি গান মুখস্ত বলতে পারেন। কিতাব আলি মৃধার এই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি তার ‘কিতাব’ নামের প্রতি সুবিচার করেছে। তার পিতা মাদার আলি মৃধা অমেদ আলি সরদারের শিষ্য ছিলেন। পিতার কাছ থেকেই কিতাব আলি মৃধা এই গানগুলি শুনে শুনে মুখস্ত করেছিলেন। অমেদ আলি সরদার যখন মারা যান তখন কিতাব আলি মৃধার বয়স ১৩ বছর।
অমেদ আলি সরদারের গানের সংখ্যা ঠিক কতো ছিল তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে শোনা যায় তিনি পাঁচ শতাধিক গান রচনা করেছিলেন। কিতাব আলি সহ সরজেত আলি নামের আর এক জন গায়েনের কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত ৭০টির মতো গান সংগ্রহ করা গেছে। আরও বেশ কিছু গান সংগ্রহের কাজ চলছে।
যে গানটিতে প্রথম অমেদ আলি সরদারের নাম শুনেছিলাম সে গানটি তার দেশকাল, ভূগোল, রাজনৈতিক প্রতিবেশ ও প্রতিভার প্রতিনিধিত্ব করে। এই গানটিকে ধরেই আমরা প্রবেশ করবো ইতিহাসের চোরাবালিতে আটকে পড়া অমেদ আলি সরদারের বিশাল গানভাণ্ডারে।
ধন্য মহারানী নিজেহে কোম্পানি
ভারতের রাজধানী দেখো না
জেলার সংখ্যা কতো ভেবে হলাম হতো
কোলকাতা চব্বিশ পরগণা
নদীয়া আর মুর্শিদাবাদ যশোর ও খুলনা
একোসাথ বর্ধমান
আছে জারভাঙ্গা হাউড়া মেদনিপুর বগুড়া
বীরভূম আর পাবনা
আরও রাজশাহী আর রংপুর বিহার দিনাজপুর
জলপাইগুড়ি দার্জিলিং জানা
আছে ফরিদপুর আর ঢাকা বাখরগঞ্জে দেখা
ময়মনসিং আর নোয়াখালী
পার্বতী ত্রিপুরা লুসাই পর্বত ধারা
চট্টগ্রাম তারা বাঙালি
পাটনা গয়া সবার সারন মছব্বারপুর চাম্পারন আর মুঙ্গুরেবলি
আছে সাওতালা পরগনা ভাগলপুর পারনা মালদাহ হুগলী
আছে সিংভূম আর মালভূম হাজারিবাগ
পালামো লডাঙা কর্পোটদামালি
বালেশ্বর কটক আর শ্রীহট্ট আরও গলপাড়া
কামরূপী তুরঙ্গপুরী লাউদা কাছুড়া
আছে খরসিনা অজান্তি শিবসাগর নাগপতি
স্বাধীন আকার সাথে লক্ষ্মীপুর
মহাকুমা ছেড়ে দেখলাম ঝোলা ঝেড়ে
এড়ায়েছি ছোট নাগপুর
মহাকুমা আছে কতো সুরপদে মেলে না ততো বিষমঘুর
আছে জজকোট কালেকটিরি জেলা বলে তারে ইংরেজ বাহাদুর
অমেদ আলির হইলো জ্বালা থেকে যশোর জেলা
সাকিম গঙ্গানন্দপুর
এই গানটিতে অবিভক্ত ভারতের ৫৪টি জেলার নাম আছে। একজন নিরক্ষরের মুখে এতোগুলো জেলার নাম শুনে তৎকালীন কোলকাতা-শিক্ষিত বাবুরা বিস্মিত হয়েছিলেন। অমেদ আলির প্রতিবেশি কোলকাতার রায়টারস বিল্ডিং-এর হেড ক্লার্ক খগেন চক্রবর্তী তার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘আমরা শিক্ষিত হয়েও এতোগুলো জেলার নাম বলতে পারবো না, তুমি লেখাপড়া না শিখেও এতোসব জানলে কি করে?’(দেশ ভাগের পর খগেন চক্রবর্তী সপরিবারে ভারতে চলে যান এবং অমেদ আলির পুত্র শমশের আলি তার বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন)। গানটির গুরুত্ব এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। সামনের আলোচনায় আমরা ঘুরে ফিরে এই গানটির কাছেই ফিরে আসবো।
বাংলা কবিগানের ইতিহাসে অমেদ আলি সরদারকে ঠিকঠাক জায়গায় প্রতিস্থাপনের জন্য কবিগানের ইতিহাসটা একবার পেড়ে দেখা দরকার। কোম্পানি আমলে কোলকাতায় কবিগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশে কবিগানের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে গবেষকদের মতভেদের শেষ নেই। শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র পাল তাঁর ‘প্রাচীন কবিওয়ালার গান’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘পশ্চিমবঙ্গই কবিগানের উৎপত্তি ও বিকাশস্থল’। তবে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ অঞ্চলের কবিগান-গবেষক বিজয় নারায়ণ আচার্য আষাঢ় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় অনুমান ব্যক্ত করেন, ‘কবি নারায়ণ দেবের পদ্মপুরাণ বা মনসার ভাসান রচনার কিছুকাল আগে ময়মনসিংহ অঞ্চলে কবিগানের প্রচলন হয়। বিভিন্ন সূত্রে জ্ঞাত হওয়া যায়, নারায়ণ দেব ষোল শতকে জীবিত ছিলেন। এ থেকে বলা যায়, সম্ভবত পূর্ববঙ্গেই সর্বপ্রথম কবিগানের উৎপত্তি হয়’। এছাড়া ব্রজসুন্দর সান্যাল ‘দমন যাত্রা’, ড.দীনেশচন্দ্র সেন ‘যাত্রা’ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘ঝুমুর’-এর মধ্যে কবিগানের উৎস খুঁজেছেন। কবিগানের অনেক আগে থেকে প্রচলিত পাঁচালি-র মধ্যেও কবিগানের উৎস অনুসন্ধান করা হয়। এমন অভিমতও রয়েছে যে, সতেরো শতকের শেষে বা আঠার শতকের প্রারম্ভে কলকাতা শহরে এক নব্য ধনিক গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য কবিগানের উৎপত্তি ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ১৩০২ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত কবিগানের সংকলন ‘গুপ্তরত্নোদ্ধার’ গ্রন্থের সমালোচনায় লিখেছেন, ‘বাংলার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবিওয়ালাদের গান’। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায়, ড. সুশীল কুমার দে, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র পাল, পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ সহ আরও অনেকের কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গের কবিগানের ইতিহাস মোটামুটি পাওয়া গেলেও, ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের কবিগানের ইতিবৃত্ত ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। ফলে এ সময়কাল পর্যন্ত যশোরের কবিগান সম্পর্কেও জানার সুযোগ অল্প।
‘বৃহত্তর যশোরের লোককবি ও চারণ কবি’ গ্রন্থে মহসিন হোসাইন এ বিষয়ে একটি মীমাংসা দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। তার ভাষ্য মতে, ‘সুবিখ্যাত ফিরিঙ্গি কবিয়াল এ্যান্টুনির একজন কবি গানের শিষ্য ছিলেন, তিনি বর্তমান ২৪ পরগনা জেলার গুমোহাবড়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি গোবিন্দতাঁতি, আর ঐ গোবিন্দতাঁতির শিষ্য ছিলেন নড়াইলের মাইচগাড়া-মাগুরার অধিবাসী কবিয়াল পাচু দত্ত সরকার। পাচু দত্ত সরকার উভয় বঙ্গে কবিগানের বায়না পেতেন। তিনিই সর্বপ্রথম কবিগান পূর্ববাংলায় আনায়ন করেন’। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৭৮৬-১৮৩৬) উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের ফরাসডাঙ্গায় বসবাস শুরু করেন। এবার আমরা আগের গানে ফিরে যায়:
‘কোলকাতা চব্বিশ পরগনা
নদীয়া আর মুর্শিদাবাদ যশোর ও খুলনা
একোসাথ বর্ধমান’
এটাই বাংলা কবিগানের উৎপত্তি ভূগোল। উৎপত্তিস্থল কোলকাতা হলে তা সবার আগে নিকটবর্তী যশোরে পৌঁছবে, সেটায় স্বাভাবিক। কারণ যশোর থেকে কোলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার আর গঙ্গানন্দপুর থেকে ভারত-সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। এবার একটু গানটির সময়কালের দিকে লক্ষ্য করি,
‘ধন্য মহারানী নিজেহে কোম্পানি
ভারতের রাজধানী দেখো না’
তার মানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই গান কোম্পানি আমলে লেখা এবং ভারত বিভাগের আগে লেখা। শতিশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুল্নার ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে গোবিন্দতাঁতি ও পাচু দত্ত সরকারের নাম উল্লেখ থাকলেও তাদের জন্ম সাল উল্লেখ নেই। তবে অমেদ আলি সরদার যে গোবিন্দতাঁতির শিষ্য পাচু দত্ত সরকারের সমসাময়িক অথবা কাছাকাছি সময়ের এ-কথা অনুমানের জন্য এখন আর বিশেষ কষ্ট-কল্পনার প্রয়োজন নেই।
‘হিন্দুর গ্রাম’ গঙ্গানন্দপুর। রাজা প্রতাপাদিত্যের শাসনের আগে থেকেই এখানে হিন্দু জমিদারদের আধিপত্য। কোম্পানি আমলেও এখানে হিন্দুরা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানরা ছিলো সাধারণ প্রজা। ব্রিটিশ শাসননীতীর সুবিধা নিয়ে হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছিলো। ধর্মীয় কুসংস্কার ও চিন্তার সংকীর্ণতা মুসলমানদের নিয়তিকে কৃষিকাজ ও সাধারণ কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলো। বেশিরভাগ হিন্দুই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইংরেজদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেছিলো। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত একটি প্রবাদে এর সত্যতা লক্ষ করা যায়:
পূর্ব দিকে সূর্য অস্ত
কলম ছাড়া হয় কায়স্ত?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মুসলমানরা বৈষম্যের শিকার হোতো। হিন্দু-মুসলমান এই বৈষম্যের ছাপ অমেদ আলির গানের মধ্যেও স্পষ্ট। কালিকা বন্দনার একটি গানে অমেদ আলি আক্ষেপ করে বলেছেন,
দ্যাও মা চরণ দু’খানা অমেদ আলির বাসনা
আমি যবনের ছেলে, তাই বলে নিদয় হলে
তাইতি মা তোর চরণ পেলাম না?
এতো কিছুর পরও সংস্কৃতির প্রশ্নে এখানকার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিশেষ এক সম্মীলন ছিলো। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার কণ্ঠে জারিত হওয়া অমেদ আলির গানগুলো তার প্রমাণ বহন করে।
কপোতাক্ষের ধার ঘেঁষা গঙ্গানন্দপুরের উত্তর পাড়ায় মাতুলালয়ে অমেদ আলির জন্ম। তার পৈতৃক নিবাস গঙ্গানন্দপুরের পাশের গ্রাম দোসতিনায় এবং স্ত্রী আহ্লাদী বেগমের বাপের বাড়িও ওই একই গ্রামে বলে জানা যায়। শ্বশুরের অঢেল বিষয়-সম্পত্তি ও কন্যাপ্রীতির কারণে অমেদ আলি সরদারের পিতা আজগর আলি সরদার তার মায়ের সাথে বিয়ের পর গঙ্গানন্দপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জমিজমা দেখাশোনা ও কৃষি কাজই ছিলো আজগর আলি সরদারের পেশা। অমেদ আলি সরদার ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র সন্তান। হিঙুল নামে তার একটা বোন ছিল। যার বিয়ে হয়েছিলো সীমান্তবর্তী ব্যাংদাহ গ্রামে।
অমেদ আলি সরদারের মামা স্বরূপ বিশ্বাস সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন। কোন বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অমেদ আলির ছিলো না। ছোটবেলায় মামাতো ভাই হারান বিশ্বাসের সাথে ইশেন চক্রবর্তীর টোলে কদাচিৎ আনাগোনা করেছেন। তবে তিনি লিখতে পারতেন না। তার গানের গুরু ছিলেন ইংরেজ-চাকুরে শশী চৌধুরী। শাস্ত্র বিষয়ে অমেদ আলির বিশেষ জানাশোনা ছিল। মুসলমানের ছেলে হয়েও হিন্দু শাস্ত্রে তার অগাধ পাণ্ডিত্য দেখে শশী চৌধুরী বলেছিলেন, ‘হিন্দু শাস্ত্রে যদি অমেদ আলি ঠকে যায়, তাহলে আমার হাতের পুছা কেটে ফেলে দেবো’। শুধু তার এই উক্তিতে নয়, অমেদ আলির প্রতিভার পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে তার প্রতিটি গানের পরতে পরতে।
অমেদ আলি পেশায় ছিলেন কবিরাজ, অবশ্য কৃষি কাজের সনাতন বীজ মিশে ছিল তার রক্তে ও ঘামে। তৎকালীন সময়ে কবিরাজি পদ্ধতিতে ঝাড়-ফুঁক, মাদুলি ও গাছ-গাছাড়ার দিয়ে চিকিৎসা করা হোতো। দূর দূর থেকে ডাক আসতো অমেদ আলির। তিনি স্ত্রী রোগ চিকিৎসায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া তৎকালীন সময়ের বড় হেকিম পরেশ নাথ বাবুর কাছ থেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাও শিখেছিলেন।
অমেদ আলির কোনো ছবি পাওয়া যায়নি। তবে কিতাব আলি মৃধার দেওয়া বিবরণে ধারণা পাওয়া যায়, তার গায়ের রং ছিল ফিঙে কালো। বেশ উচু-লম্বা শরীরের গড়ন। তবে শেষ বয়সে কুঁজো হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতেন। তার অমেদ নামটি সার্থক হয়েছিলো, শরীরে এক বিন্দু মেদ ছিলো না। কোমর ছিলো সুপারি গাছের মতো সরু। মাথায় চুল না থাকলেও মুখে সাদা লম্বা দাড়ি ছিল। তিনি সব সময় সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও মাথায় সাদা টুপি পরতেন।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও বিশ শতকে যশোরে কবিগানের জোয়ার ছিল। কবিগান হয়ে উঠেছিলো জনসাধারণের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কবিগান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই গানে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য কোনো জাতির মধ্যে এরূপ গান দেখা যায় না।’ গঙ্গানন্দপুরের আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে কবিগানের দল ছিলো। অমেদ আলি গোয়ালহাটি, পেড়ের ঘোপ, গুলবাগপুর সহ আনেক দূরের দলের সাথে কবিগানের পাল্লায় অংশ নিয়েছেন। সমাজের বিত্তবান মানুষেরা বায়না দিয়ে গানের দল ভাড়া করে নিয়ে আসতেন। বায়নার পরিমান ছিল ২০ টাকা। এছাড়া প্রতিযোগে যে দল বিজয়ী হোতো তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কারের ব্যাবস্থা ছিলো।
কবিগান পরিবেশিত হতো বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় কিম্বা অন্য কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চাঁদা সংগ্রহের জন্য, বিয়ে-সাদি, পূজা-পার্বণ সহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে। অনেক সময় কোথাও নতুন করে হাট বসানোর জন্য হাট কমিটি কবিগানের মাধ্যমে লোক জমায়েত করতেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে সবচেয়ে বেশি কবিগানের আসর বসতো। বর্ষার কারণে মানুষের কাজ কম থাকতো। সে সময় যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো নৌকা ও গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে সাধারণত মহিলারা যাতায়াত করতেন। পুরুষেরা সচরাচর যাতায়াত করতেন পায়ে হেটেই। দূর-দূরান্ত থেকে নৌকায় চড়ে ও পায়ে হেঁটে লোক আসতো গান শুনতে। একেকটি আসরে দু’ পাঁচশ’ লোকের সমাগম ঘটতো।
গলার স্বর ভালো না থাকায় শেষ বয়সে অমেদ আলি নিজে গান গাইতেন না। তিনি গান তৈরি করে সুর বলে দিতেন দলের অন্যরা গাইতেন। গান আগেও বাঁধা থাকতো, আবার পাল্লার প্রয়োজনে আসরে বসেই তাৎক্ষণিক ভাবে গান রচনা করতেন। আসরে বসে যে সব গান বাঁধতেন তা অনেক সময় যারা লেখাপড়া জানতেন তারা লিখে রাখতেন। এই শ্রুতিলেখকদের মধ্যে বাদল মোড়ল অন্যতম।
কবিগানের আসরে দু’টি দল আসতো। প্রতিটি দলের সদস্য সংখ্যা ৮/১০ জন। ৩ জন ৩ জন করে গান গাইতেন আর ২ জন বাদ্যবাজনা করতেন। ঢোল ও খঞ্জনিই ছিলো এ গানের প্রধাণ বাদ্যযন্ত্র। খালি গলায় তারা সারা রাত গান গাইতেন। দু’দলের নেতৃত্বে থাকতেন দু’জন কবিয়াল বা সরকার। আসরে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে একদল সম্পর্কে অন্য দলের কোন কিছু জানার সুযোগ থাকতো না। আসরে কবিয়াল ছাড়া আসা উভয় দলের সদস্যরা আদ্যাশক্তির বন্দনামূলক ডাকসুর ও মালসী গেয়ে আসর শুরু করতেন। তারপর একদল এসে সখী-সংবাদের ‘দূতী সংবাদ’, ‘মাথুর’ অথবা ‘মান’-এ ধরনের কোন চাপান দিত। তখন অপর দলের কবিয়াল তার দলকে জবাব (উতোর) হিসেবে একটি গান বেঁধে দিলে সেই দল গানটি পরিবেশন করে অন্য দলের উদ্দেশ্যে দিত আরেকটি গানের চাপান। মূল কবিয়াল বা সরকার আসরে উঠতেন প্রথম চাপানের পর। চাপান ও উতোর এগিয়ে চলত। অবশেষে ‘যোটক’ গানের মাধ্যমে কবিগানের সমাপ্তি ঘটতো। আসরের সমাপ্তি ঘটলেও কবিগানের সমাপ্তি ঘটতো না কখনো। সাধারণ কৃষক সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এই গান মুখস্ত করে রাখতো। সুযোগ পেলেই কারণে অকারণে তারা এই গানগুলি গেয়ে উঠতো।
কৃষকরা যখন মাঠে গাঁতা বেঁধে কাজ করতেন তখন তারা কবিগানের দলের আদলে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতেন। তারপর একসাথে চলতো কাজ ও অমেদ আলির গানের পাল্লা। একদল গেয়ে ছেড়ে দিলে আর এক দল শুরু করতেন। গান গাইতে গাইতে এক পর্যায়ে শুরু হোতো নাচানাচি। তারপর সারা মাঠ ভরে যেতো ধুলোয়। সারাদিনের কাজের ক্লান্তি উপশমে এই গানগুলো টনিকের মতো কাজ করতো।
কবিগানের বিষয় বিস্তৃত। বিভিন্ন ধরনের গানের উপাদান এর মধ্যে বিদ্যমান। অমেদ আলির গানেও আমরা এই বিষয় বৈচিত্র্য লক্ষ করি। তার গানগুলোর মধ্যে দেহতত্ত্ব মূলক গান, আত্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব মূলক গান, ভাব গান, বিচ্ছেদ গান, রামায়ণের গান, রাধা কৃষ্ণের গান, জারি গান, মর্সিয়া গান, মুর্শিদি গান, ধুয়া গান ও পল্লী গান প্রভৃতির সংমিশ্রণ রয়েছে। তবে এক বিশেষ ধরণের গানে অমেদ আলির পারদর্শিতা প্রশংসার দাবি রাখে। তা হলো ‘নামের গান’: জেলার নামে গান, গ্রামের নামে গান, মাছের নামে গান, পাখির নামে গান, ঘাসের নামে গান ইত্যাদি। এসব গানে এমন অনেক মাছের নাম, পাখির নাম, ঘাসের নাম আছে যেগুলো আগে ছিলো কিন্তু এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
দেহতত্ত্বের গানে অমেদ আলির যাতায়াত ছিল সবচেয়ে সচ্ছন্দ। তার রচিত গানের মধ্যে এধরণের গানের সংখ্যাই অধিক।
দিননাথ এক রথ গঠেছে দুই চাকারই উপরে
হাওয়ার জোরে ঘোরে ফেরে শব্দ না করে
ও তার তক্তা জোড়া সাতটি মুড়া তিনশতবা রইলো বাকে
জোলোই মারা রঙের ধারা দেখলে জুড়ায় দুই আঁখি
জলে স্থলে করে বৃদ্ধি ভাবি একাকি
আবার জলে স্থলে করে বৃদ্ধি সাদ্ধি বোঝার কে আছে
আধার ঘরে কারিগরে রথখান গঠেছে
আবার দশে ইন্দ্র ছয়ে রিপু তারাই রথের পর রইয়াছে
আটচল্লিশ হাজার দম দিয়ে রথ রাত্র দিবস চালাচ্ছে
রথের জতিক ছড়ায় বাতিক ঝলক দিতেছে
আর নয় দরজা দেখতে মজা সাজা দেয় দিন রজনী
রথের ঘোড়া মারলে মুড়া অচল দুখনি
আবার নয় দরজার কথা বলো শুনবো আমি আজ এখনি
আবার কোন দরজা বন্ধ হলে চলে না রথ তা শুনি
কোন মোকামের দরজা সেডা অমেদ তার চাইতো নিশানি
প্রথমদিকে কবিগান রচিত হতো পৌরাণিক বিষয়ের আশ্রয়ে। বিশ শতকের তিরিশ দশক পর্যন্ত বাংলায় এই বিষয়-আশয়েই কবিগান চলছে। সাথে থাকতো খিস্তি, খেউড়, বিকৃত রুচি ও অশ্লীলতা। এ-কারণে প্রথম দিকে কবিগান অনুষ্ঠিত হোতো লোকালয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে নির্জন যায়গায়। সে-জন্য কবিগান হয়ে উঠেছিলো প্রাপ্ত বয়স্কদের গান। এখনো পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গালাগালি ও অশ্লীল কথার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘কবিগাওয়া’ শব্দটির ব্যবহার কবিগানের অশ্লীলতার ইঙ্গিত বহন করে। বস্তুত উভয় বঙ্গে উদ্ভবকাল থেকে এভাবেই কবিগানের যাত্রা। অমেদ আলি ঊনিশ শতকের শেষে কবিয়াল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কবিগান করেন। কবিগানকে একেবারে বিকৃত রুচি, অশ্লীলতা ও গালি মুক্ত করে, পৌরাণিক ও কাল্পনিক বিশ্ব থেকে মাটিতে নামিয়ে এনে তাকে মার্জিত ও সুন্দরকরণে, শালীনতা আনয়ন ও উপস্থাপনা রীতি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ভাসান গানের অশ্লিলতাকে কটাক্ষ করে লেখা অমেদ আলি সরদারের একটি গানকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায়ঃ
কলিকাল অকাল হল দায় ঘটলো কলি হল রাজা
কুপথেতে কেউ চোলো না, ধর্ম পথটি সোজা
বুঝি তাই ঘটে এলো হেরো কলুর ভাসান এলো দেশে
আবাল বৃদ্ধ খ্যাপ্তা হলো মত্ত হোল রসে
গ্রাম কাগমারি জুম্মার ঘরের সামনে দেলে গান
ঠেলাঠেলি করে তারা গরু করলে দান
ওরা কাল দিয়েছে ভালো, জানা গেলো আমরা ভারত ছাড়া
ওরা দিয়েছে থালা কাপড় আমরা দেবো ঘড়া
তার পরে মেঠো পাড়ায় পাতালে ব্যায় নামে আমির আলি
প্রেম আলিঙ্গন দিয়ে তারা করছে কুলাকুলি
বাড়ি তার জুম্মার ঘর দিনদার বলবে দুঃখ করে
রসের ভাসান জুড়ে দেলে সেই জুম্মার ঘরের দোরে
ঘরের মর্তবা আছে আগে পাছে বাঁজায় যদি ঢোল
শাস্ত্র মতে ধরে তারে করিবা কতল
ঘটে না আইন মতে এই জগতে বাংলা কাবা ঘর
ওক্তে আজান না দিলে ভাই যাবা ছারেখার।
এই গানটিতে একদিকে যেমন আদিরসাশ্রয়ী ভাসান গানের নিন্দা করেছেন অপরদিকে ধর্মের প্রতি তার আনুগত্যতা প্রকাশ পেয়েছে। অমেদ আলি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করতেন। কিন্তু গায়েন হওয়ার অপরাধে মাঠুয়া পাড়া মসজিদের ইমাম ফকির মুন্সি তাকে সামনের কাতারে দাড়াতে নিষেধ করেন। তারপর থেকে আমৃত্যু অমেদ আলি সরদার পেছনের কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। অমেদ আলির মৃত্যুতে অজস্র লোকের সমাগম ঘটেছিলো এবং বিদেহী আত্মার প্রতি এতো বিপুল পরিমান কলেমা বকশিশ করেছিলো যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি। এ ঘটনার পর ফকির মুন্সি ইমাম তার কৃতকর্মের জন্য সকলের কাছে মাফ চেয়ে নিয়ে ছিলেন।
অমেদ আলি সরদারকে অপরাজেয় কবিয়ালও বলা হয়। কারণ তাঁর সাথে কবির লড়াই করে কেউ কোনদিন জিততে পারেন নি। যশোরের কবিগানে অঞ্চলপ্রীতির স্থলে স্বদেশপ্রীতি আনতেও তিনি ভূমিকা রাখেন। এই কবিয়াল সম্পর্কে বিস্তৃত গবেষণার দাবি রাখে। এছাড়া বাংলার আনাছে কানাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকরত্নগুলো উদ্ধার করে আমাদের মাতৃকোষকে সমৃদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি মাত্র।