ঠিকানা টিভি ডট প্রেস: মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলার কথা মনে আছে? খেলার নিয়ম একটু আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে সকলে বসেন। একটি বালিশ থাকে, বাজনা শুরু হলেই সে বালিশটি একজন আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করা শুরু করেন। এটাকে আমরা বলি ‘পিলো পাসিং’। এভাবে খেলা চলতে থাকে। যখন মিউজিক থেমে যাবে, তখন যার কাছে বালিশ তিনি খেলা থেকে বাদ পড়বেন। এভাবে একে একে বাদ পড়তে থাকেন। শেষে যিনি বালিশ মুক্ত থাকতে পারবেন, তিনি এই খেলায় বিজয়ী হন। স্কুল-কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এই খেলার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এখন এতো বছর পর ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের উপদেষ্টামণ্ডলীর দপ্তর ঘন ঘন রদবদল দেখে আমার সেই ‘মিউজিক্যাল পিলো’র খেলার কথা মনে পড়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন, এই উপদেষ্টামণ্ডলী এক ধরনের মিউজিক্যাল খেলা খেললো।
৮ আগস্টের পর থেকে তৃতীয় দফায় উপদেষ্টামণ্ডলীর কলেবর বাড়ল। উপদেষ্টামণ্ডলীর কলেবর বাড়তেই পারে। কারণ বাংলাদেশ এখন একটি বড় অর্থনীতির দেশ। মন্ত্রণালয়গুলোর কাজের পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। কাজেই প্রথম থেকেই বলা হচ্ছিলো, মাত্র অল্প কয়েকজন উপদেষ্টা দিয়ে কাজ করা কতটুকু সম্ভব হবে। অবশেষে উপদেষ্টামণ্ডলী প্রথম দফায় ৪ জন বাড়ানো হয় এবং গতকাল আরো কয়েকজনকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু উপদেষ্টামণ্ডলীতে নতুন অন্তর্ভুক্তি হওয়ার বিষয়টি চেয়ে আমার কাছে যেটি বিস্ময়কর মনে হয়েছে তা হল উপদেষ্টামণ্ডলীর রদবদল। শুরু থেকেই উপদেষ্টামণ্ডলীর বিভিন্ন চেয়ার গুলো যেন মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো। কে কখন কোন চেয়ারে বসবেন তার কোন ঠিক নেই। সকালে দপ্তর করে সন্ধ্যায় জানলেন তিনি আর ঐ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেই। একটি মন্ত্রণালয়ে একজন উপদেষ্টা যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তাঁর বুঝে উঠতে সময় লাগে। সেখানকার আমলা এবং কর্মকর্তাদের সাথে অন্যান্য বিভাগ ও অধিদপ্তর গুলোর সাথে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হতেও একটা সময় লাগে। আর এই কারণেই যে কেউ যখন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন, তখন তাঁকে একটি নির্দিষ্ট সময় দেয়া উচিত বলেই অনেকের ধারণা। চটজলদি করে একজনকে উপদেষ্টাকে একটি মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে, সেই মন্ত্রণালয়ের কাজে এক ধরনের গতিহীনতা তৈরি হয়, স্থবিরতা তৈরি হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পরেন। সৃষ্টি হয় ভুল বোঝাবুঝি।
উপদেষ্টামণ্ডলী যখন গঠিত হয় তখন এম সাখাওয়াত হোসেনকে দেয়া হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ এবং ৭.৬২ গুলি নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেন, যা স্পর্শকাতর। ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের তাঁর পছন্দ হয়নি। তাঁকে বদলি করে দেয়া হয় একেবারে গুরুত্বহীন পাট মন্ত্রণালয়ে। অনেকে ধারণা করেছিল যে এই মন্ত্রণালয়ে তিনি হয়তো অপমানিতবোধ করবেন, উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দিবেন- এই রকম কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি থাকেন এবং পরবর্তীতে তাঁর আবার দপ্তর বদল হলো। পরিচিত সভা করতে করতেই তাঁর বদলী হচ্ছে। কাজ করবেন কি’?
এবার আরেকজন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হাসান আরিফকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি ৮ আগস্ট পর থেকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ করে তাঁকে সরিয়ে সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অন্তত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর মন্ত্রাণালয়। সারা দেশের স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালিত হয় এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। প্রশাসনের সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয় এটি। প্রশ্ন হল যে, সদ্য শিক্ষা জীবন শেষ করে আসা এই তরুণ কী এতো বড় মন্ত্রাণালয় সামলাতে পারবেন? যদি শুধুমাত্র এটিই (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়) তাঁর মন্ত্রণালয় হতো, তাহলে কথা ছিল। এছাড়া তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করছেন। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনকে শ্রম ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার যে, অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি এখন শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন প্রাজ্ঞ এবং যথেষ্ট সন্মানীয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। মাত্র তিন মাস তিনি বাণিজ্য মন্ত্রাণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ী সেখ বশিরকে এবং ইতিমধ্যে যাঁকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে অর্ন্তভুক্ত করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক এবং বিক্ষোভ। তিনি একটি হত্যা মামলার আসামীও বটে। অনেকেই বলছেন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অন্যদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিয়ে জনমতে তীব্র বিতর্ক এবং অসন্তোষ দেখা গেছে। বিশেষ করে তাঁর নিয়োগের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ধুম বইছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বা সাংস্কৃতি অঙ্গনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কোন বিশেষ অবদানের কথা কেউ মনে করতে পারে না। বরং নাটকের বিকৃতি, বাংলা নাটকে ভাষা ধ্বংস করা, নাটকের মধ্যে পরকিয়া, কুরুচি এবং নোংরামীকে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি সমালোচিত। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে অনেক বিশিষ্ট গুরুজন এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। সেখানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মতো সস্তা আজগুবী একজন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা করাটা সত্যিই সত্যিই বিস্ময়কর। সরকার যদি সত্যিই সত্যিই সংস্কৃতি অঙ্গনে কিছু করতে চাইতো তাহলে আবুল কাশেম ফজলুল হক এর মতো গুনী ব্যক্তি আছেন যাঁকে বাংলা একাডেমির সভাপতি করা হয়েছে, তাঁকে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা করা যেত। এতে কোন দোষের ছিল না। এই নিয়োগের মধ্য দিয়ে উপদেষ্টামণ্ডলীর সাংস্কৃতিক মান নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
আলী ইমাম মজুমদারকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসাবে নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁকে উপদেষ্টা করা হয়। তাঁর কোন দপ্তর ছিল না। তবে তিনি জনপ্রশাসন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দেখতেন। এখন তাঁকে সরাসরি খাদ্য উপদেষ্টা করা হয়েছে। প্রশ্ন হল খাদ্য উপদেষ্টা হয়ে আলী ইমাম মজুমদার আসলে কি করবেন? সারা জীবন আমলার দায়িত্ব পালন করা আলী ইমাম মজুমদার খাদ্যে কতটুকু কি করবেন এটি নিয়ে এক ধরনের বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে থাকা মাহফুজ আলমকে উপদেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে কোন দপ্তর দেয়া হয়নি। তবে ধারণা করা যায়, খুব শীঘ্রই তাকে নতুন দপ্তর দেয়া হবে, তখন হয়তো উপদেষ্টামণ্ডলীতে আরেকটা রদবদল আমরা দেখতে পাবো।
সাধারণ মানুষের কাছে এখন দুটি বড় প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্নটি হল উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা কি? সাধারণভাবে ধরেই নেয়া যায় যে, এই সরকার যেহেতু আওয়ামী লীগকে উৎখাত করে ক্ষমতায় এসেছে, কাজেই আওয়ামী লীগ বিরোধী ব্যক্তিদের তাঁরা উপদেষ্টামণ্ডলীতে রাখবে। এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করাই সরকারের একটি বড় কাজ, যেটি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বলেছেন। তাই যদি হয় তাহলে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করাই কি উপদেষ্টা হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা? তাহলে তো চারপাশে বহু আওয়ামী লীগ বিরোধী আছে। তাদেরকে উপদেষ্টামণ্ডলী করলেই হয়। যাঁদের করা হচ্ছে তাঁরা কী সত্যিই আওয়ামী লীগ বিরোধী? দেখা যাচ্ছে যে সমস্ত ব্যক্তিদের উপদেষ্টা করা হচ্ছে, যাঁরা সুবিধাভোগী। সব সরকারের আমলে যাঁরা বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরাই এখন উপদেষ্টামণ্ডলীতে জায়গা পাচ্ছেন। উপদেষ্টামণ্ডলীতে আওয়ামী লীগের সময়ে ভাল অবস্থানে ছিলেন-এ রকম অন্তত ছয়জন উপদেষ্টার নাম বলা যায়, যাঁরা এই সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উপদেষ্টামণ্ডলীতে জায়গা পেয়েছেন। এদের বিগত আন্দোলনে কোন ভূমিকা নেই। তাহলে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা উপদেষ্টামণ্ডলীর একমাত্র যোগ্যতা নয়। সে ক্ষেত্রে যোগ্যতা কী?
ধারণা করা হয় যে কয়েকজন উপদেষ্টা তাঁদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ করছেন। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস আসলে ক্রীড়নক মাত্র। একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা রয়েছেন, তিনি তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের উপদেষ্টামণ্ডলীতে ঢোকাচ্ছেন। এই সব অভিযোগের সত্য মিথ্যা আমরা জানি না। তবে এদেশে এখন অনেক গুজব সত্য। কিন্তু যাঁদেরকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে নেয়া হয়েছে তাঁদের অনেকেরই যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন আকিজ-বশির গ্রুপের সেখ বশিরকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে তাঁর চেয়ে অনেক বড় এবং শিল্পক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাঁদেরকে এই উপদেষ্টামণ্ডলীতে নেয়া হয়নি। যেমন স্কয়ার গ্রুপের তপন চৌধুরী অনেক বেশি ব্যবসায়ীদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে তিনি বেশি ওয়াকিবহাল। অনেকেই অনেকে মনে করেন, এপেক্স গ্রুপের সৈয়দ নাসিম এলাহীর মতো ব্যক্তিত্বরাও উপদেষ্টামণ্ডলীতে বিবেচিত হতে পারতেন। কিন্তু তা না হয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সেখ বশিরকে উপদেষ্টা করা হয়েছে ব্যক্তিগত সখ্যতার বিচারে। তাঁর মানে এই সরকার মুখে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার কথা বললেও আসলে যাঁরা তাঁদের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে সম্পর্কিত, যাঁদের সাথে তাঁদের ঘনিষ্ঠ তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, একজন উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু যোগ্য? সমাজে তাঁর অবদান কতটুকু এবং তিনি ওই মন্ত্রণালয়ে কী অবদান রাখতে পারবেন সে সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত যাচাই বাছাই না করে উপদেষ্টা নেয়া হচ্ছে। যেমন-মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশাল প্রেক্ষাপটে কোন ভূমিকাই নেই। কিন্তু তাঁকে সংস্কৃতি উপদেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র চাটুকারিতা, ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার জোরে উপদেষ্টামণ্ডলীতে জায়গা হচ্ছে। এটি সরকারের কর্মদক্ষতাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করবে তেমনি সরকারের ভাবমূর্তিতে বিতর্কিত করছে। আর এ কারণেই উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম হাস্য তামাশার সৃষ্টি হয়েছে।’