নিজস্ব প্রতিবেদক: এবার উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে অংশগ্রহণ করেনি। দলীয় প্রতীকও ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। তারপরও আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতারা তাদের আত্মীয় স্বজন ও মাই ম্যানদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করেন এবং এই সমস্ত এলাকায় প্রভাব বিস্তারেরও অভিযোগ এসেছিল। অনেকে মনে করেন যে, এলাকায় প্রভাব অক্ষুন্ন রাখা এবং দলের ভিতর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তাদের মাই ম্যানদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করেছিলেন।
কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের তিন ধাপ অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে যে, বহু স্থানে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের আত্মীয় স্বজন এবং মাই ম্যানরা ধরাশায়ী হয়েছেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটা বড় শিক্ষা বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর ফলে বিভিন্ন এলাকায় মাই ম্যান গড়ে তুলার প্রতিবাদে তৃণমূলের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের বিজয় হয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন।’
এবার উপজেলা নির্বাচনে যে সমস্ত আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের স্বজন এবং মাই ম্যানরা পরাজিত হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রীর ছোট ভাই, সাবেক কৃষি মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের খালাত ও মামাত ভাই, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামালের ছোট ভাই, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শাসছুল হক টুকুর ছোট ভাই ও ভাতিজা, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই এবং মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি এম তাজুল ইসলামের ভাতিজা। এরা সবাই নির্বাচনে স্ব স্ব উপজেলা থেকে পরাজিত হয়েছেন। এই উপজেলা নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের পক্ষ থেকে প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল এবং এই সমস্ত প্রার্থীরা বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছেন।
২৯ মে অনুষ্ঠিত হয় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। সেখানে ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই শাহাদাত হোসেন প্রার্থী হয়েছিলেন। শাহাদাত হোসেনের প্রতি ওবায়দুল কাদেরের সমর্থন ছিল বলে এলাকার ভোটাররা মনে করেন। এই নির্বাচনে চার জন প্রার্থীর মধ্যে তিনি টেলিফোন প্রতীকে ৪৬১০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন, তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শাহাদাতের হেরে যাওয়া রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে। নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য শাহাদাত হোসেন তার ভাই বাসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জাকে দায়ী করেছেন। কিন্তু যাকেই দায়ী করুন না কেন তার জামানত বাজেয়াপ্ত এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।’
২১ মে দ্বিতীয় ধাপে কুমিল্লা সদরের দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১০ আসনের সংসদ সদস্য আ হ ম মোস্তফা কামালের ছোট ভাই গোলাম সরওয়ার পরাজিত হয়। গোলাম সরওয়ার এর আগে তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এবার তিনি তৃতীয় হন। আওয়ামী লীগের নেতারা আ হ ম মোস্তাফা কামালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিহ্ন হিসেবেই এই নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ওই নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হাই বাবলু ছিলেন তৃণমূলের ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বক্তব্য, মন্ত্রীর ভাই হিসেবে সরওয়ার সব সময় প্রভাব বিস্তার করতেন এবং মন্ত্রীর পরিবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল এলাকায়। এছাড়াও এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই নেতার বিভক্তিও স্পষ্ট ছিল। কারণ যিনি বিজয়ী হয়েছেন তাকে সমর্থন দেন কুমিল্লা সদর আসনের আওয়ামী লীগের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন। তবে এই নির্বাচনের ফলাফলে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিরোধ আরও বেড়ে গেল বলে অনেকেই মনে করছেন।’
তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচনে হেরে গেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানকিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ডা. জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই মোহাম্মদ ইসরাফিল হোসেন। এই নির্বাচনে সরাসরি তাকে সমর্থন দেন জাহিদ মালেক। ২০১৯ সালে মোহাম্মদ ইসরাফিল বিনা ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এখানেও আওয়ামী লীগের লোকজন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারাম উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে হেরে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনের সংসদ সদস্য এ বি তাজুল ইসলামের ভাতিজা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম তুষার। এভাবে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতাদের পরাজয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।’